ভারত রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে অন্য দেশ থেকে গম আমদানির রাস্তা খুঁজছে বাংলাদেশ। যদিও সে কাজটা খুব বেশি সহজ নয় বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, ভারতের রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অন্যান্য গম আমদানিকারক দেশও বিকল্প পথ খুঁজছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ কমায় রপ্তানিকারক দেশগুলোও বাড়তি চাপে পড়ছে। সেখানেও গমের দাম দ্রুত বাড়ছে। ফলে বিকল্প উৎসে গম মিললেও গুনতে হবে চড়া দাম।
অন্যদিকে ভারতের এ নিষেধাজ্ঞায় জি-টু-জি (সরকার থেকে সরকার) পর্যায়ে বাংলাদেশের গম আমদানিতে বাধা পড়েনি। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ হিসেবে অনুমতি সাপেক্ষে ভারত গম রপ্তানির একটি সুযোগও রেখেছে। সে সুবিধা পেলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাও গম আনতে পারবেন।
যদিও মঙ্গলবার (১৭ মে) গম রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছে ভারত। দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গমের যেসব চালান পরীক্ষার জন্য কাস্টমের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং ১৩ মে বা এর আগে তাদের কাছে নিবন্ধিত হয়েছে, এ ধরনের চালানগুলো রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হবে।
তথ্য বলছে, বিশ্বের অন্যতম দুই গম রপ্তানিকারক দেশ ইউক্রেন ও রাশিয়া। যুদ্ধের কারণে এই দুই দেশ থেকে রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে হঠাৎ ভারত গম রপ্তানি বন্ধ করায় আন্তর্জাতিক বাজারে এ পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। গত তিনদিনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে গমের বেঞ্চ মার্ক সূচক ৫ দশমিক ৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে, যা দুই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। চলতি বছর আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বেড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ।
এমন পরিস্থিতিতে সরকার ৫টি বিকল্প উৎস থেকে গম আমদানির চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সোমবার সচিবালয়ে তিনি বলেন, কানাডা থেকে গম নেওয়ার বিষয়ে হাইকমিশনারের সঙ্গে কথা হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকেও আমরা গম আমদানির উদ্যোগ নেব।
তবে বিকল্প আমদানির পথ খুব একটা সুগম হবে না বলে জানান দেশের শীর্ষ আমদানিকারকরা।
এ নিয়ে টিকে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ কালাম বলেন, যুদ্ধের পর থেকে গমের বাজার টালমাটাল। আবার ভারতের এ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আমদানি চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে। রাশিয়া, ইউক্রেন আর ভারত বন্ধ থাকায় এখন রপ্তানিকারক সীমিত কয়েকটি দেশে ঝুঁকবে সবাই।
দেশে উৎপাদিত গম-ফাইল ছবি
তিনি বলেন, তাতে এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে গমের দাম ৪০০ থেকে ৫২০ ডলার পর্যন্ত উঠেছে। এটি আগে ৩০০ থেকে সাড়ে তিনশ ডলার ছিল।
এম এ কালাম বলেন, এ পরিস্থিতিতে যেটুকু পাওয়া যাবে তার জন্য চড়া দাম গুনতে হবে।
বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার খবর আমদানিকারক দেশ হিসেবে আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার। সেজন্য আমরা বড় চ্যালেঞ্জেরে মুখে পড়েছি। তবে সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিলে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার এ ধাক্কা কাটাতে সমস্যা হবে না। সরকারকে এখন অন্তরিক হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, নিষেধাজ্ঞার আগে খোলা ঋণপত্রের গম যাতে দেশে আনা যায়, সে উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গম দেওয়ার জন্য কার্যক্রম চালাতে হবে। ভারত থেকে গম আমদানি চলমান থাকলে সবচেয়ে সুবিধা হবে।
গত শুক্রবার গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় ভারত। তবে এর আগে এলসি খোলা হয়েছে এমন গম আসতে বাধা নেই। এর আগে ভারতীয় সরবরাহকারীদের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের চুক্তি করা হয়েছে, এমন গমের পরিমাণ প্রায় পাঁচ লাখ টন। এছাড়া ভারতের নিষেধাজ্ঞার প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দেশগুলো, যারা নিজেদের খাদ্যনিরাপত্তার চাহিদা পূরণের চেষ্টা করছে, তাদের অনুরোধে গম রপ্তানির অনুমতি বিবেচনায় থাকবে। সে সুযোগ নিতে পারবে বাংলাদেশ।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ভারতের নিষেধাজ্ঞার পরেও জি-টু-জি (সরকার থেকে সরকার) পর্যায়ে গম আমদানির সুযোগ রয়ে গেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় আগ্রহ দেখালে বা চাহিদাপত্র দিলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সেই অনুযায়ী গম আমদানির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে খাদ্য সচিব ড. নাজমানারা খানুম বলেন, জি-টু-জি ভিত্তিতে ভারত থেকে আমদানি চলমান। আজও (সোমবার) একটি টেন্ডার হয়েছে। এ কার্যক্রম আরও বাড়ানো হবে।
তিনি বলেন, পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের যে আমদানির সুযোগ রয়েছে, সে বিষয়ে ভারতের হাইকমিশনারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি সম্মতি জানিয়েছেন।
নাজমানারা খানুম আরও জানান, ভারতের বাইরে অন্য দেশ থেকেও গম আনার জন্য মন্ত্রণালয়ে কাজ চলছে। বুলগেরিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউক্রেন ও রাশিয়াসহ অন্য রপ্তানিকারকদের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা চলছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছর দেশে সরকারিভাবে গম আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৪২ হাজার টন। বেসরকারি খাতে আমদানি হয়েছে ৩০ লাখ টন। এছাড়া সরকারের আরও তিন লাখ টন আমদানি প্রক্রিয়া চলমান। চলতি অর্থবছরের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত আরও ৬ লাখ ২৬ হাজার ৩৮০ টন গম আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন গুদামে মজুত আছে ১ লাখ ১৮ হাজার টন গম।
ব্যবসায়ীরা এও বলছেন, ভারত বা বিকল্প দেশ থেকে আমদানি নিশ্চিত করা গেলে সাময়িক দাম বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে বড় কোনো শঙ্কা নেই। কারণ বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ গমের মজুত ও ঋণপত্র খোলা রয়েছে তাতে আগামী দু-তিন মাস গমের জোগানে কোনো সমস্যা হবে না। এছাড়া আমাদের দেশীয় ফলন উঠছে এখন, যা দিয়ে আরও কয়েক মাস চলতে পারে। আবার তিন-চার মাস পর বিভিন্ন দেশে ফলন আসবে। সে সময় পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের গম বিশ্ববাজারে সরবরাহ হবে। তখন বাড়তি চাপ কেটে যাবে।
এদিকে গমের এ পরিস্থিতির পর থেকে পণ্যটির দাম বাড়ছে। সর্বশেষ ভারত গম আমদানি বন্ধের খবরের পরদিন দেশে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) আটার দাম ২০০ টাকা বেড়েছে। ভালো মানের এক বস্তা আটা এখন ২ হাজার ২৫০ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মানভেদে ২ হাজার ৪৮০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকার ময়দা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার টাকায়।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, গত এক বছরে আটার দাম কেজিতে বেড়েছে ৬ থেকে ১৩ টাকা এবং ময়দায় বেড়েছে ১৮ থেকে ২৪ টাকা পর্যন্ত।
অন্যদিকে বাজারে আটা ও ময়দার দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে হোটেলের রুটি ও পরোটা থেকে শুরু করে বেকারি পণ্যেও।