গেলো রোজায়ও ঈদের পরে সরকার পতনের আন্দোলনের হুঁশিয়ারি ছিল বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মুখে। আবার একাংশের বক্তব্য ছিল, আন্দোলন দিনক্ষণ বেঁধে হয় না। আন্দোলন তার স্বাভাবিক নিয়মে পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। ‘ঈদের পর কঠোর আন্দোলন’- এই ট্যাগ লাইন আঁকড়ে নেতাকর্মীদের চাঙা রাখার প্রচেষ্টা বা কৌশল গত আট বছর ধরে চালাচ্ছে বিএনপি।

২০১৪ সালের ২২ জুন বিকেলে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে জয়পুরহাটে এক জনসভায় ঈদের পরে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণার হুঁশিয়ারি দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সে বছর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করার পর তৃতীয়বারের মতো ঢাকার বাইরে জনসভায় দেওয়া ভাষণে খালেদা জিয়া বলেন, ‘ইনশাল্লাহ, ঈদের পর আন্দোলন শুরু করবো। দুর্নীতিবাজ সরকারকে বিদায় করবো। আন্দোলনের জন্য আপনারা প্রস্তুত হন।’

বাংলাদেশের রাজনীতিতে কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি বলতে হরতাল-অবরোধ পরিচিত। ২০১৪ সালে দেশে ২২টি হরতাল ডাকা হয়। এর মধ্যে সাতটি ডাকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। ২০১৫ সালের প্রথম দিনটি ছিল জামায়াতের হরতাল। ৬ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। কিন্তু কর্মসূচি ঘোষণা করে নেতারা আত্মগোপনে যাওয়ায় এক পর্যায়ে ঘোষণা ছাড়াই শেষ হয় সে অবরোধ।

আট বছর আগে দলীয় প্রধানের ওই বক্তব্যের রেশ ধরে ঈদ সামনে রেখে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা এখনো এ ধরনের বক্তব্য দেন। ঈদ যায় ঈদ আসে কিন্তু সেই অর্থে কোনো কঠোর আন্দোলন সংগঠিত করতে পারেনি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। ফলে বিরোধী শিবির থেকে নিয়মিত কটাক্ষ শুনতে হয় দলের নেতাকর্মীদের।

এবারের ঈদুল ফিতরের আগেও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু আলাদা অনুষ্ঠানে ঈদের পর সরকার পতনের আন্দোলনের কথা বলেন। তবে ঈদের পর মির্জা আব্বাস একাধিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বক্তব্য রাখলেও সরকার পতনের কর্মসূচি নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি।

ঈদের পরের কর্মসূচির বিষয়ে জানতে চাইলে রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, ঈদের পরে দুই দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। কর্মসূচি শুরু হয়ে গেছে। এই কর্মসূচি ক্রমান্বয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনে রূপ নেবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির মধ্যমসারির এক নেতা বলেন, খালেদা জিয়া ২০১৪ সালে জয়পুরহাটে বলেছিলেন ঈদের পরে সরকার পতনের কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়া হবে। এও বলেছিলেন, সরকার যদি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করে তাহলে আন্দোলন থেকে বিরত থাকা হবে। তারপরে কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা হয়েছে, কিন্তু কৌশলগত ভুলে সেই আন্দোলনের ফসল ঘরে তোলা যায়নি।

ঈদের পর সরকার পতনের কঠোর কর্মসূচির বিষয়ে নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট রফিক শিকদার বলেন, আন্দোলনের নানান গতিপ্রকৃতি থাকে। ২০০৮ সালের পর থেকেই আমরা আন্দোলনে আছি। বাস্তবতার নিরিখে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা হয়। রমজান মাসে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকেন। যে কারণে ওই সময়ে সেভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় না। তাই বলা হয় ঈদের পরে কর্মসূচি ঘোষণা হবে। কর্মসূচি নিয়মিত ঘোষণা হচ্ছে।

বিএনপির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, ঈদের পরে সরকার পতনের কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি- এই বক্তব্য চেয়ারপারসন অথবা মহাসচিব দেননি। এটা দলের বক্তব্য না। এই বক্তব্য যে বা যারা দিয়েছেন সেটা তাদের ব্যক্তিগত বক্তব্য। এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে হাস্যরস সৃষ্টি করেন।

‘বিএনপিকে যারা ফলো করেন, তারা দেখবেন, দলের দুজন সিনিয়র নেতা আছেন। এদের মধ্যে একজনের মুড ঠিকঠাক থাকলে তিনি কর্মসূচিতে এসে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে হাস্যরসাত্মক বক্তব্য দেন। আরেকজন আছেন তিনি সবাইকে হাত উঁচু করিয়ে আন্দোলনের শপথ পাঠ করান।’

বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ  বলেন, আমরা সাংগঠনিক সম্পাদকরা ব্যস্ত আছি সাংগঠনিক কাজে, আগামী জুনের মধ্যে আমাদের এই সাংগঠনিক কাজ শেষের নির্দেশনা রয়েছে। এই কাজ শেষ হলে আমাদের চলমান আন্দোলন আরও কঠোর হবে।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের ভাষ্য, দিনক্ষণ বেঁধে আন্দোলন হয় না।

ঈদের আগে-পরে আন্দোলনের এই মানসিকতার পরিহারের আহ্বান জানান তিনি।

এদিকে এবারের ঈদুল ফিতরের পর বিএনপির পক্ষ থেকে দুটি বিক্ষোভ কর্মসূচি এবং দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ১০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।

ঈদের পর সরকার পতনের কঠোর কর্মসূচি- দলের সিনিয়র নেতাদের এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা যা কিছু করছি সবই আন্দোলন, আন্দোলনের অংশ। আপনারা যা চাইছেন তা শিগগির দেখতে পাবেন।

রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন খানের দাবি, বিএনপির আন্দোলনের ঈদের চাঁদ এখনো অমাবস্যায় নিমজ্জিত। প্রায় এক যুগ ধরে দল পুনর্গঠনের নামে দলের মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয়েছে সারাদেশে। যে কারণে তারা আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি।

তিনি আরও বলেন, সরকার পতনের জন্য কঠোর আন্দোলন করতে হলে সুসংগঠিত সংগঠন থাকা লাগে। সুসংগঠিত সংগঠন থাকা তো দূরের কথা, বিএনপি এখন সংগঠিতই নয়। যে কারণে ঈদের পরে সরকার পতনের কঠোর কর্মসূচি- এ ধরনের ভাষণ দিয়ে নেতারা তাদের কর্মীদের উজ্জীবিত রাখার চেষ্টা করেন।