ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে জানমাল রক্ষায় দেশের উপকূলীয় এলাকায় মাটির কিল্লা নির্মাণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তীসময়ে জনগণের কাছে এটি ‘মুজিব কিল্লা’ নামে পরিচিতি পায়। দীর্ঘদিন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবসহ নানাবিধ কারণে বেদখল হয়ে যায় এসব কিল্লা। বর্তমান সরকার সেগুলো ফের সংস্কার ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় ২০১৮ সালে। কিন্তু চার বছরে নির্মাণকাজে দেখা গেছে ধীরগতি। এরই মধ্যে নতুন করে বাড়ানো হয়েছে সময় ও ব্যয়।

বিদ্যমান ১৭২টি মুজিব কিল্লা সংস্কার ও উন্নয়নের পাশাপাশি নতুন করে নির্মাণ করা হবে ৩৭৮টি কিল্লা। ফলে মোট মুজিব কিল্লার সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৫০টি। দেশের ঘূর্ণিঝড়প্রবণ ১৬টি জেলার ৬৪টি উপজেলা এবং বন্যা ও নদী ভাঙনপ্রবণ ২৪টি জেলার ৮৮টি উপজেলায় এগুলো নির্মাণ ও সংস্কার হবে।

‘মুজিব কিল্লা নির্মাণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় এ উদ্যোগ নেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। প্রকল্পের কাজ ২০১৮ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়, যা শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু সময়মতো কাজ শেষ না হওয়ায় এর মেয়াদ বাড়ছে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। পাশাপাশি ব্যয় বাড়ছে ৪০ কোটি টাকা। মূল প্রকল্পের ব্যয় ধরা ছিল ১ হাজার ৯৯৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে চার বছরে প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৮৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বা ১৬ শতাংশ। তবে প্রকল্পের আওতায় কোথাও কোথাও কিল্লা নির্মাণে জমি পাওয়া যাচ্ছে না।

ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচতে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে মানুষ

প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যমাত্রা
দুর্যোগকালে কিল্লার আশপাশের জনসাধারণ ও তাদের মূল্যবান সামগ্রী রক্ষা, গৃহপালিত প্রাণীদের নিরাপদ আশ্রয়} নিশ্চিতকরণ, স্বাভাবিক সময়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি খেলার মাঠ ও হাট-বাজার হিসেবে কিল্লা ব্যবহার করা। গ্রাম ও ইউনিয়ন কমিউনিটির মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বৈঠকখানা হিসেবে ব্যবহার করা হবে কিল্লা। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ও দুর্যোগের সময় অস্থায়ী সেবাকেন্দ্র হিসেবেও কিল্লা ব্যবহার করা হবে।

প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম
১৮৬টি মুজিব কিল্লা ‘এ’ ক্যাটাগরির। এর মধ্যে বিদ্যমান ৫৫টি কিল্লা পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার হবে। নতুন করে নির্মাণ হবে ১৩১টি।

‘বি’ ক্যাটাগরির মুজিব কিল্লা হবে ১৭১টি। এর মধ্যে বিদ্যমান ৬৩টি পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করা হবে। নতুন করে নির্মাণ হবে ১০৮টি।

‘সি’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে ১৯৩টি মুজিব কিল্লা। এর মধ্যে ৫৪টি বিদ্যমান মুজিব কিল্লা পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার হবে, ১৩৯টি নির্মাণ হবে নতুন করে।

প্রকল্প এলাকা
গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, পিরোজপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর, নড়াইল, সুনামগঞ্জ ও চাঁদপুরে নির্মাণ করা হবে এসব মুজিব কিল্লা।

প্রকল্পের আওতায় কোথাও কোথাও কিল্লা নির্মাণে জমি পাওয়া যাচ্ছে না

বেড়েছে প্রকল্পের মেয়াদ
বর্তমান সময় পর্যন্ত ‘মুজিব কিল্লা নির্মাণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ১৬ শতাংশ। এর মধ্যে আবার করোনার কারণে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) প্রকল্প এলাকায় আসতে পারেনি। সব মিলিয়ে এক বছর বাড়ছে এর মেয়াদ।

কম্পিউটার খাতে ব্যয় বৃদ্ধি
নানা কারণে প্রকল্পের কিছু বিষয় সংশোধন হচ্ছে। এর মধ্যে কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক খাতে বেড়েছে ব্যয়। মূল ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) সাতটি কম্পিউটারের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু প্রকল্প দপ্তরে নিয়োজিত আছেন ১৬ কর্মকর্তা। জনপ্রতি একটি করে কম্পিউটার রাখা হয়েছে। ফলে এ খাতে বেড়েছে ব্যয়।

পরামর্শক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি
মূল প্রকল্পে পরামর্শক খাতে ব্যয়ের জন্য ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ধরা হয়েছিল। পরে এটা করা হয় ৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে বুয়েট ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা উত্তোলন করে।

রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং
প্রথমে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বুয়েট খেলার মাঠে রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং (বিশেষ পদ্ধতিতে কূপের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে রিজার্ভ) ডিজাইন করে। কিন্তু মাঠে ৮-১১ ফুট পর্যন্ত বালু ভরাট হয়ে থাকে। ফলে সেখানে পানি ধরে রাখা সম্ভব নয়। বৃষ্টির সময় ময়লা পানি ভরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই প্রকল্পের সব সাইটের মাঠে রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং না করার সিদ্ধান্ত হয়।

অতিরিক্ত কাজের অন্তর্ভুক্তি
বিভিন্ন সাইটে বেশি করে মাটি ভরাট কাজ করতে হচ্ছে। এছাড়া বাড়ছে শেডের ফ্লোরের কাজ। বজ্ররোধক প্রযুক্তি লাইটনিং অ্যারেস্টার স্থাপনের কারণেও ব্যয় ও সময় বাড়ছে।

জ্বালানির পরিমাণ বৃদ্ধি ও গাড়ি ভাড়া
প্রকল্পের জন্য কেনা দুটি গাড়িতে জ্বালানি হিসেবে অকটেন ব্যবহার হয়। প্রতিটি গাড়িতে মূল ডিপিপিতে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে মাসে ১৭৫ লিটার তেল। বর্তমানে জ্বালানি তেলের পরিমাণ বাড়িয়ে প্রতি মাসে গড়ে ৪০০ লিটার ধরা হয়েছে।

এছাড়া প্রকল্পটি দেশের ৪০টি জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস্তবায়িত হচ্ছে। সেখানে কাজের তদারকির জন্য যাতায়াত করতে হয়। তাই সঠিকভাবে কাজের মনিটরিংয়ের জন্য তিনটি গাড়ি ভাড়া করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক  বলেন, চলমান প্রকল্পের কিছু কাজ করতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কিছু জিনিস বাদ দিতে হবে, আবার কিছু যোগ করতে হবে। ঝামেলা রয়েছে জমি নিয়ে। এর মধ্যে আবার করোনা- সবমিলিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি কম। অন্যদিকে রড-সিমেন্টের দামও বেড়েছে। ফলে কাজে লাগানো যাচ্ছে না ঠিকাদারদের।

প্রকল্পের ব্যয় বাড়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা প্রকল্পটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি। ব্যয় কিছু বাড়বে। পাশাপাশি প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ করতে এক বছর সময় প্রয়োজন।