গত দুই বছরে বোনাস শেয়ার দেওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে সার্বিকভাবে লভ্যাংশ দেওয়ার হারও। ব্যাংকগুলো বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশ দিলেও তেমন আকৃষ্ট করতে পারছে না পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের। ফলে ভালো লভ্যাংশের প্রভাব পড়ছে না ব্যাংকের শেয়ার দামে।
ব্যাংকের শেয়ার বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে না পারার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের শেয়ারবাজার এখন অনেকটাই আইটেমনির্ভর হয়ে পড়েছে। বিনিয়োগকারীরা এখন দ্রুত মুনাফা পাওয়ার আশায় বিনিয়োগ করছেন, লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় নয়। বিনিয়োগকারীদের এ আচরণ যুক্তিসঙ্গত নয়। এভাবে আইটেমনির্ভর বিনিয়োগ করলে লাভের বদলে লোকসানের মধ্যে পড়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
তারা আরও বলছেন, খেলাপি ঋণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দেশের ব্যাংকখাত সমস্যার মধ্যে রয়েছে। তবে ব্যাংকের অবস্থা যে খুব খারাপ তা নয়। বেশিরভাগ ব্যাংক এখন ভালো করছে। বিনিয়োগকারীদের উচিত বিনিয়োগের আগে প্রতিষ্ঠানের আর্থিকচিত্র পর্যালোচনা করা। ভালোভাবে তথ্য যাচাই না করে গুজবের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করা উচিত নয়।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ২০২১ সালের সমাপ্ত বছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ১৫টি শেয়ারহোল্ডারের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ৯টিই ২০২০ সালের চেয়ে বেশি লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত বছরের চেয়ে বেশি লভ্যাংশ দেওয়ার পাশাপাশি এই ব্যাংকগুলোর মধ্যে ছয়টিই গত বছরের চেয়ে বেশি নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এছাড়া বেড়েছে গত বছরের চেয়ে কিছু কম লভ্যাংশ ঘোষণা করা একটি ব্যাংকের নগদ লভ্যাংশের পরিমাণও।
অন্যদিকে যমুনা ব্যাংক ২০২০ সালের মতো সাড়ে ১৭ শতাংশ নগদ, পূবালী ব্যাংক সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ এবং আইএফআইসি ব্যাংক ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে যমুনা ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংকের নগদ লভ্যাংশের পরিমাণ ২০১৯ সালের তুলনায় বেড়েছে। বরাবরের মতো কোনো ধরনের লভ্যাংশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সমস্যার মধ্যে থাকা আইসিবি ইসলামী ব্যাংক। এর মধ্যে যমুনা ব্যাংকের শেয়ার দাম ২২ টাকা ৯০ পয়সা এবং পূবালী ব্যাংকের শেয়ার দাম ২৬ টাকা ৫০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।
শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১০ সালের মহাধসের পর শেয়ারবাজার আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর প্রধান কারণ ব্যাংকখাতের দুরবস্থা। একের পর এক ব্যাংকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার দিয়েছে মাত্রাতিরিক্ত। এতে একদিকে ব্যাংকের শেয়ার সংখ্যা বেড়েছে, অন্যদিকে কমেছে নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার সক্ষমতা। যে কারণে কয়েক বছর ধরে বেশিরভাগ ব্যাংক লভ্যাংশের ক্ষেত্রে অনেকটাই বোনাস শেয়ারনির্ভর হয়ে পড়ে।
তারা বলছেন, দুই বছর ধরে ব্যাংকগুলোর মধ্যে নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস দেওয়ায় প্রতিটি ব্যাংকের শেয়ার সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে বড় বিনিয়োগকারীরা এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করতে খুব একটা আগ্রহী হচ্ছেন না। যে কারণে এখন ভালো লভ্যাংশ দেওয়ার পরও বেশিরভাগ ব্যাংকের শেয়ার দাম অবমূল্যায়িত অবস্থায় পড়ে থাকছে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালের জন্য কম লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে দুটি ব্যাংক। এর মধ্যে ডাচ-বাংলা ব্যাংক ২০২১ সালের জন্য সাড়ে ১৭ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২০ সালে ব্যাংকটি শেয়ারহোল্ডারদের ১৫ শতাংশ নগদ ও ১৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়। অর্থাৎ মোট লভ্যাংশের পরিমাণ কমলেও ব্যাংকটির নগদ লভ্যাংশের পরিমাণ বেড়েছে। এর আগে ২০১৯ সালে ১৫ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার এবং ২০১৮ সালে ১৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয় ব্যাংকটি। বর্তমানে ব্যাংকটির শেয়ার দাম ৬৩ টাকা ১০ পয়সা।
ইস্টার্ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ২০২১ সালের জন্য সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ এবং সাড়ে ১২ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগের বছর ২০২০ সালে ব্যাংকটি শেয়ারহোল্ডারদের সাড়ে ১৭ শতাংশ নগদ ও সাড়ে ১৭ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়। তার আগে ২০১৯ সালে ব্যাংকটি ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল। এই ব্যাংকটির শেয়ার দাম ৩৮ টাকা।
ব্র্যাক ব্যাংক ২০২০ সালের মতো ২০২১ সালেও শেয়ারহোল্ডারদের ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এবার ব্যাংকটির নগদ লভ্যাংশের পরিমাণ কমেছে এবং বেড়েছে বোনাস লভ্যাংশের পরিমাণ। ব্যাংকটি ২০২১ সালের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের সাড়ে ৭ শতাংশ নগদ ও সাড়ে ৭ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগের বছর ২০২০ সালে ১০ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়। তার আগে ২০১৯ সালে সাড়ে ৭ শতাংশ নগদ ও সাড়ে ৭ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়। ব্যাংকটির শেয়ার দাম ২৬ টাকা ৫০ পয়সা।
এদিকে আগের বছরের চেয়ে বেশি লভ্যাংশ ঘোষণা করা ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে উত্তরা ব্যাংক। ২০২১ সালের জন্য প্রতিষ্ঠানটি ১৪ শতাংশ নগদ ও ১৪ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগের বছর ২০২০ সালে ব্যাংকটি সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ ও সাড়ে ১২ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়। তার আগে ২০১৯ সালে ব্যাংকটি ৭ শতাংশ নগদ ও ২৩ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়। এ ব্যাংকটির শেয়ারের বর্তমান দাম ২৩ টাকা ৩০ পয়সা।
দ্বিতীয় স্থানে থাকা সিটি ব্যাংক সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ ও সাড়ে ১২ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগের বছর ব্যাংকটি সাড়ে ১৭ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়। তার আগে ২০১৯ সালে ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এ ব্যাংকটির শেয়ারের বর্তমান দাম ২৬ টাকা ৫০ পয়সা।
লভ্যাংশ বাড়া ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ ও শেয়ার দামের চিত্র
ব্যাংকের নাম | শেয়ার দাম (টাকা) | লভ্যাংশ | ||||
২০২১ | ২০২০ | ২০১৯ | ২০১৮ | ২০১৭ | ||
ব্যাংক এশিয়া | ১৮.৯০ | ১৫ শতাংশ নগদ | ১০ শতাংশ নগদ | ১০ শতাংশ নগদ | ৫ শতাংশ নগদ এবং ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার | ১২.৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
মার্কেন্টাইল ব্যাংক | ১৪.৮০ | ১২.৫ শতাংশ নগদ এবং ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার | ১০ শতাংশ নগদ এবং ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার | ১১ শতাংশ নগদ এবং ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার | ১৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার | ১৭ শতাংশ নগদ এবং ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
এনআরবিসি | ২৩.১০ | ৭.৫০ শতাংশ নগদ এবং ৭.৫০ শতাংশ বোনাস শেয়ার | ৭.৫০ শতাংশ নগদ এবং ৫ বোনাস শেয়ার | |||
প্রিমিয়ার ব্যাংক | ১৬.৩০ | ১২.৫ শতাংশ নগদ এবং বোনাস শেয়ার | ১২.৫ শতাংশ নগদ এবং ৭.৫ বোনাস শেয়ার | ৫ শতাংশ নগদ এবং ৫ বোনাস শেয়ার | ১৫.৫ বোনাস শেয়ার | ১৫ বোনাস শেয়ার |
প্রাইম ব্যাংক | ২২.৩০ | ১৭.৫ শতাংশ নগদ | ১৫ শতাংশ নগদ | ১৩.৫ শতাংশ নগদ | ১২.৫ শতাংশ নগদ | ৭ শতাংশ নগদ এবং ১০ বোনাস শেয়ার |
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক | ২০.১০ | ১০ শতাংশ নগদ এবং ৫ বোনাস শেয়ার | ৭ শতাংশ নগদ এবং ৫ বোনাস শেয়ার | ৫ শতাংশ নগদ এবং ৫ বোনাস শেয়ার | ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার | ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার |
ইউসিবি | ১৪.৬০ | ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার | ৫ শতাংশ নগদ এবং ৫ বোনাস শেয়ার | ৫ শতাংশ নগদ এবং ৫ বোনাস শেয়ার | ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার | ১০ শতাংশ নগদ |
ডিএসইর এক সদস্য বলেন, ব্যাংকের শেয়ার সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে বড় বিনিয়োগকারীরা এ খাতের প্রতি খুব একটা আগ্রহী হন না। বড় বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগ না করায় দাম সেভাবে বাড়ে না। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও খুব একটা আগ্রহী হয় না ব্যাংকের শেয়ারের প্রতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, লভ্যাংশ বিবেচনা করলে এখন ব্যাংকের শেয়ার সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ উপযোগী। কিন্তু আমাদের শেয়ারবাজারে প্রকৃত বিনিয়োগকারীর সংখ্যা খুবই কম। এই বাজারে অধিকাংশ জুয়া খেলতে চায়। যে কারণে ব্যাংক ভালো লভ্যাংশ দেওয়ার পরও বিনিয়োগকারীদের খুব একটা আকৃষ্ট করতে পারছে না।
ব্যাংকগুলোর নগদ লভ্যাংশ বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্দেশনার ফলে ব্যাংকগুলোকে এখন একটি নির্দিষ্ট হারে নগদ লভ্যাংশ দিতে হচ্ছে। এর চেয়ে কম নগদ লভ্যাংশ দিলে বেশি ট্যাক্স দিতে হবে। এটাই ব্যাংকগুলোর নগদ লভ্যাংশ বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ।