ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার তিন বছর আজ ১০ এপ্রিল। মাদরাসা অধ্যক্ষের শ্লীলতাহানির প্রতিবাদ করায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল মারা যান প্রতিবাদী নুসরাত। এ ঘটনায় ২৪ অক্টোবর ফেনীতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মামুনুর রশিদ বহুল আলোচিত এ মামলায় অভিযুক্ত ১৬ আসামির মৃত্যুদণ্ড ও এক লাখ টাকা করে জরিমানার আদেশ দেন। আলোচিত এ মামলায় দৃষ্টান্তমূলক রায় ঘোষণার তিন বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত তা কার্যকর না হওয়ায় পরিবার ও স্বজনদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

জানা যায়, সোনাগাজী ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ প্রত্যাহার না করায় ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে ছাদে ডেকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে নুসরাতকে হত্যার চেষ্টা করে তার সহপাঠীরা। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে তার মৃত্যু হয়।

মৃত্যুর পরই ঘটনাটি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশি গণমাধ্যমেও সমালোচনার ঝড় তোলে। ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসেন আন্দোলনকারীরা। এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন।

অন্যদিকে শ্লীলতাহানির ঘটনায় নুসরাতকে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও ধারণ করে তা প্রচারের ঘটনায় সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ব্যারিস্টার ছায়েদুল হক সুমন আইসিটি আইনে আরও একটি মামলা করেন।

নুসরাতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এখনো পুলিশ ওই বাড়িটিতে পাহারা বসিয়ে নুসরাতের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দিয়ে আসছেন। বাড়িতে এখনো চাঞ্চল্য ফেরেনি। এখনো নুসরাতের বাবা, মা ও দুই ভাই তার স্মৃতিরোমন্থন করে কেঁদে চলেছেন।

মামলার বাদী নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, আমার বোনকে হত্যার ঘটনায় আদালত যথাযথ রায় ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তিন বছর পর্যন্ত রায় কার্যকর না হওয়া অপ্রত্যাশিত। এছাড়াও আসামিদের স্বজনরা ফেসবুকে আমাদের পরিবার ও স্বজনদের নিয়ে নানা অপপ্রচার চালিয়ে আসছে।

নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বলেন, প্রশাসন থেকে শুরু করে দেশের সব মানুষের সহযোগিতায় আমরা আদালতে সঠিক বিচার পেয়েছি। আমি আমার মেয়ের খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাতে এ রায় কার্যকরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন।

নুসরাতের পরিবারের সদস্য, পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ফেনী সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে ২৬ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা তার অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। এ ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে আসামি করে মামলা করেন। মামলায় ওই দিনই পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেফতার করে।

ওই মামলা তুলে নিতে অধ্যক্ষের অনুসারী ও সহপাঠীরা নুসরাত ও তার পরিবারের সদস্যদের চাপ দিতে থাকে। ২০১৯ সালের ৩ এপ্রিল খুনিরা সিরাজের সঙ্গে কারাগারে পরামর্শ করে ৪ এপ্রিল মাদরাসার ছাত্রাবাসে নুসরাতকে খুন করার পরিকল্পনা নেয়। ৬ এপ্রিল নুসরাত আলীম পরীক্ষা দিতে গেলে সহপাঠীরা সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে হত্যার চেষ্টা চালায়। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। পরে ফেনী জেনারেল হাসপাতাল ও অবস্থার অবনতি হলে নুসরাতকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল মারা যান নুসরাত।

এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। মামলাটির প্রয়োজনীয় তদন্ত শেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ১৬ আসামিকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয়। ২০ জুন অভিযোগ গঠন করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। পরে ৬১ কার্যদিবসের মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২৪ অক্টোবর রায় ঘোষণাকালে সকল আসামির ফাঁসির আদেশ দেন বিচারক মামুনুর রশীদ। পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে একলাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়।

সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ-দৌলা (৫৭), নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা পপি (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন মামুন (২২), সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি ও মাদরাসার সাবেক সহ-সভাপতি রুহুল আমিন (৫৫), মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ও মোহাম্মদ শামীম (২০)।

নিম্ন আদালতে রায়ের পর প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ, নুর উদ্দিন, জাবেদ হোসাইন ও উম্মে সুলতানা পপি খালাস চেয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। এখন উচ্চ আদালতে আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

বাদীপক্ষের আইনজীবী এম. শাহজাহান সাজু জানান, ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) মামলার যাবতীয় কার্যক্রম হাইকোর্টে পৌঁছে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ হলে তা অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় কার্যক্রম উচ্চ আদালতে পাঠাতে হয়। সে অনুসারে ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক (মামলার যাবতীয় নথি) ছাপানো শেষ করা হয়েছিলো। পরে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে শুনানির জন্য মামলাটি প্রধান বিচারপতি বরাবর উপস্থাপন করা হয়। আপিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন করেছেন প্রধান বিচারপতি। বিচারপতি হাসান ইমাম ও সৌমেন্দ্র সরকার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ মামলার শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়। দীর্ঘদিন করোনা পরিস্থিতির কারণে শুনানি না হওয়ায় ওই বেঞ্চ বাতিল হয়েছে। এরপর বেঞ্চ গঠন হয়নি। শুনানিও হচ্ছে না।

শিগগির আলোচিত এ মামলার পরবর্তী আইনগত কার্যক্রম শেষ করে রায় কার্যকরের দাবি এ আইনজীবীর।

এছাড়া নুসরাতের ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগে ২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল তৎকালীন সোনাগাজী মডেল থানার ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে বাদী হয়ে মামলা করেন ব্যারিস্টার ছায়েদুল হক সুমন। মামলাটি তদন্ত শেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ২৭ মে মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দিলে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা দেন আদালত। ১৬ জুন রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ১৭ জুলাই অভিযোগ গঠন শেষে ৩১ জুলাই থেকে এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয়। ২০ নভেম্বর উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ২৮ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। রায়ে ওসি মোয়াজ্জেমের ৮ বছরের জেল ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন ট্রাইব্যুনাল। এটি বাংলাদেশের প্রথম সাইবার ট্রাইব্যুনালের প্রকাশিত রায়।

নুসরাত হত্যার তিন বছর উপলক্ষে রোববার (১০ এপ্রিল) সোনাগাজী পৌরসভার উত্তর চরচান্দিয়া এলাকায় মিলাদ মাহফিল ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ওই আয়োজনে আলোচিত এ মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক শাহ আলমসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা নুসরাতের সমাধিস্থলে পুস্পস্তবক অর্পন ও জিয়ারতের আয়োজন করেছেন।