চট্টগ্রামের টিএসপি কমপ্লেক্স থেকে যশোরে যাওয়া ১৭ ট্রাক টিএসপি সার নিয়ে বেধেছে তুলকালাম। সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছায়নি সারবোঝাই ১৭ ট্রাকের একটিও। নির্ধারিত সময়ের পর পৌঁছেছে ১২ ট্রাক। বাকি পাঁচ ট্রাক সারের এখনো কোনো হদিস নেই। যে ১২ ট্রাক পৌঁছেছে এর মধ্যে আবার পাঁচ ট্রাক সারে পাওয়া গেছে ভেজাল। তবে এ ঘটনায় ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ আসামির বিরুদ্ধে মামলা করা ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি কর্তৃপক্ষ। সরকারি ভর্তুকির এ সার কৃষক পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছানো এবং এর মান নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, যশোরের বাফার গোডাউনে পৌঁছানোর জন্য গত ১৪ মার্চ ১১টি ট্রাকে ১৫৪ টন ও ১৫ মার্চ ছয়টি ট্রাকে ৮৭ টনসহ মোট ২৪১ টন টিএসপি সার গ্রহণ করে পরিবহন ঠিকাদার মেসার্স সৈয়দ এন্টারপ্রাইজ। স্বাভাবিকভাবে গেলে ১৫ ও ১৬ মার্চ এসব সার যশোর পৌঁছানোর কথা থাকলেও ১৭ মার্চ পাঁচ ট্রাক সার সেখানে পৌঁছায়। এসব সার ভেজাল সন্দেহ হওয়ায় যশোর বাফার গোডাউন ম্যানেজার আকতারুল হক সেসব সারের খালাস বন্ধ করে দেন। পরে গোডাউন ম্যানেজার বিষয়টি লিখিতভাবে বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশন (বিসিআইসি) ও টিএসপি কর্তৃপক্ষকে জানালে বিসিআইসির নির্দেশে ট্রিপল সুপার ফসফেট কমপ্লেক্স লিমিটেড (টিএসপিসিএল) কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি ২০ মার্চ যশোর থেকে সন্দেহযুক্ত সারের নমুনা সংগ্রহ করে।

সংগৃহীত নমুনা ল্যাবে পরীক্ষা করে পাওয়া যায় ভেজালের প্রমাণ। পরবর্তীসময়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবহন ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত নেয় টিএসপিসিএল। গত ২৭ মার্চ টিএসপিসিএলের উপ-মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) মোহাম্মদ সোলায়মান বাদী হয়ে যশোর কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেন। মামলায় দণ্ডবিধির ৪০৬, ৪১৭, ৪২০ ধারাসহ সার ব্যবস্থাপনা আইনের ১৭(৩) ধারায় অভিযোগ করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, যশোর পৌঁছানোর জন্য চট্টগ্রামের পতেঙ্গা টিএসপিসিএল কারখানা থেকে গত ১৪ মার্চ ৭৭৭৪৪ নম্বর চালানমূলে ১১ ট্রাকে ১৫৪ টন টিএসপি সার গ্রহণ করে ঠিকাদার সৈয়দ এন্টারপ্রাইজ। এই ১১ ট্রাকের প্রতিটিতে ১৪ টন করে সার নেওয়া হয়। ট্রাকগুলো হচ্ছে- ঢাকা-মেট্রো-ট-১৮-৯৪৯০, ঢাকা-মেট্রো-ট-১৮-৮৪৯৭, ঢাকা-মেট্রো-ট-১৮-৪৭৮৬, ঢাকা-মেট্রো-ট-১৬-৪৪৮১, ঢাকা-মেট্রো-ট-১৮-৩১৩৫, ঢাকা-মেট্রো-ট-১৮-০৭৬৭, চুয়াডাঙ্গা-ট-১১-০৪০৩, ঝিনাইদহ-ট-১১-১৩৪৮, ঝিনাইদহ-ট-১১-০৯১৬, ঝিনাইদহ-ট-১১-১৭২৩ ও ঝিনাইদাহ-ট-১১-১৩০৬।

পরদিন (১৫ মার্চ) ৭৭৭৫০ নম্বর চালানমূলে ছয় ট্রাকে ৮৭ টন টিএসপি সার গ্রহণ করে ঠিকাদার সৈয়দ এন্টারপ্রাইজ। ট্রাকগুলোর মধ্যে যশোর-ট-১১-৩৯০৫, যশোর-ট-১১-৪৫২৩ এবং ঢাকা-মেট্রো-ট-২৪-৬২২০ নম্বর ট্রাকে ১৫ টন করে এবং ঝিনাইদহ-ট-১১-০৯৮২, ঢাকা-মেট্রো-ট-১৫-০১৩৬ ও ঢাকা-মেট্রো-ট-০১৮-০৬২১ নম্বরের ট্রাকে ১৪ টন করে সার নেওয়া হয়।

এরপর ৭০ টন সার নিয়ে পাঁচটি ট্রাক ১৭ মার্চ যশোর বাফার গোডাউনে পৌঁছায়। ট্রাকগুলো হচ্ছে ঝিনাইদহ-ট-১১-১৩৪৮, ঝিনাইদহ-ট-১১-০৯১৬, ঢাকা-মেট্রো-ট-১৫-০১৩৬, ঝিনাইদহ-ট-১১-০৯৮২ এবং ঢাকা-মেট্রো-ট-১৮-০৬২১।

টিএসপিসিএল সূত্রে জানা যায়, যশোর বাফার গোডাউনে তদন্ত দল গিয়ে সন্দেহযুক্ত পাঁচ ট্রাক থেকে সারের ছয়টি নমুনা সংগ্রহ করে নিজস্ব ল্যাবে পরীক্ষা করে। এতে সারে ভেজাল মেশানোর প্রমাণ পায়। একইভাবে এসব নমুনা অধিকতর পরীক্ষার জন্য মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে পরীক্ষা করা হয়। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের পরীক্ষায়ও প্রতিটি নমুনায়ই ভেজালের প্রমাণ পাওয়া যায়। তথ্য অনুযায়ী, টিএসপি সারে সাধারণত ৪৬ শতাংশ ফসফেট থাকে। সেখানে নমুনা পরীক্ষায় এসব সারে ফসফেটের উপস্থিতি পাওয়া যায় ২৮-৩১ শতাংশ।

এদিকে পাঁচ ট্রাক ভেজাল সার আটকের পর পরবর্তীকালে সাত ট্রাকের সার স্বাভাবিকভাবে খালাস হয় যশোর বাফার গোডাউনে। কিন্তু দুদিনে ১৭ ট্রাকে ২৪১ টন সার চট্টগ্রাম থেকে গ্রহণ করলেও পরিবহন ঠিকাদার ২৮ মার্চ পর্যন্ত যশোর বাফার গোডাউনে ১২ ট্রাকে ১৩৮ টন (ভেজাল পাঁচ ট্রাকসহ) সার পৌঁছায়। অন্যদিকে প্রায় ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও বাকি পাঁচ ট্রাক সার যশোর বাফার গোডাউনে সরবরাহ করেনি। এসব সারের বর্তমান অবস্থান কোথায়, সে বিষয়েও সারের মালিকানা প্রতিষ্ঠান টিএসপিসিএলের কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে ২৮ মার্চ মামলার পর ‘যশোর-ট-১১-৩৯০৫’ নম্বরের ১৫ টন টিএসপি সারবাহী ট্রাকটি বাফার গোডাউনে গেলেও কর্তৃপক্ষ সারগুলো গ্রহণ করেনি বলে দাবি ঠিকাদারের।

এদিকে পাঁচ ট্রাক ভেজাল সার জব্দের পর একই চালানে আরও ৭৩ টন সার ২০ দিন ধরে কোথায় রয়েছে তা এখনো জানে না টিএসপিসিএল। এ বিষয়ে ঠিকাদারকে শুধু চিঠি দিয়েই দায় সারছে প্রতিষ্ঠানটি। পাঁচটি ট্রাকের মধ্যে ঢাকা-মেট্রো-ট-১৪-৯৪৯০ ও চুয়াডাঙ্গা-ট-১১-০৪০৩ নম্বর ট্রাকে ১৪ টন করে এবং যশোর-ট-১১-৩৯০৫, যশোর-ট-১১-৪৫২৩, ঢাকা-মেট্রো-ট-২৪-৬২২০ নম্বর ট্রাক তিনটিতে ১৫ টন করে সার ছিল।

সরকারি সারে ভেজালের প্রমাণ পেয়েও পরিবহন ঠিকাদারকে তাৎক্ষণিক আইনের আওতায় না আনার বিষয়ে জানতে চাইলে টিএসপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আতাউর রহমান  বলেন, সার পরিবহন করার জন্য ঠিকাদার মেসার্স সৈয়দ এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছে। এজন্য চুক্তিমূল্যের ৫ শতাংশ জামানত হিসেবে ব্যাংক গ্যারান্টি রাখা আছে। সারে যেহেতু ভেজাল পাওয়া গেছে, সেহেতু চুক্তি লংঘনের কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

সরকারি ভর্তুকির সার পরিবহনের ক্ষেত্রে পথে ভেজাল মিশিয়ে পুনরায় সরকারি গোডাউনে সরবরাহের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলেও ঠিকাদারকে সরাসরি আইনের হাতে তুলে দেওয়া আইনসিদ্ধ নয় বলে মনে করেন এ ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

সরকারি সার কারখানা থেকে বুঝে নিয়ে ২০ দিনেও গন্তব্যে না পৌঁছানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ভেজাল সারের জন্য দায়ের করা ওই মামলায়ই পাঁচ ট্রাক সার না পৌঁছানোর কারণে আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়েছে। বিষয়টি এখন তদন্তাধীন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখবে।

এদিকে দায়ের করা মামলায় এজাহারনামীয় আসামি করা হয়নি ওই পাঁচটি ট্রাকের চালক ও তাদের সহযোগীদের।

ভেজাল মেশানো সারের ট্রাক

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এ সরকারি কর্মকর্তা বলেন, আমরা থানায় মামলা করেছি। ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক পুলিশ তাদের আইনের আওতায় আনবে।

তিনি বলেন, এরই মধ্যে জামানতের দুই কোটি ৬৬ লাখ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি নগদায়ন করা হয়েছে। ভেজাল ও আত্মসাৎ করা সারের মূল্য এক কোটি টাকার কম। তারপরও চুক্তি অনুসারে পরিবহনকালে অভিযুক্ত হলে দ্বিগুণ জরিমানার বিধান রয়েছে। এখন নগদায়ন করা জামানতের অর্থ থেকে জরিমানার ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে। তাছাড়া কালো তালিকাভুক্ত করা হবে প্রতিষ্ঠানটি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার উপ-পরিদর্শক এজাজুল হক বলেন, মামলা হয়েছে মাত্র কয়েকদিন হয়েছে। আমি এখনো পুরো ফাইল দেখিনি।

আত্মসাৎ করা পাঁচ ট্রাক সার উদ্ধারের বিষয়ে পদক্ষেপ কী, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ট্রাকগুলোর বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি। আমার কাছে আরও কিছু তথ্য রয়েছে। মামলা তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

তবে ভিন্ন কথা বলছেন পরিবহন ঠিকাদার মেসার্স সৈয়দ এন্টারপ্রাইজের মালিক আহসান হাবীব।

তিনি বলেন, কার্যাদেশে লেখা আছে ৩০ দিনের মধ্যে মাল (সার) গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। ৩০ দিন পার না হলে আত্মসাতের কথা বলা যাবে না। পাঁচ ট্রাক সার আটকের পর টিএসপিসিএলের পক্ষ থেকে আমাকে বলা হয়েছে, আগে যে মালগুলোয় (সার) ভেজাল পাওয়া গেছে, সেগুলোর নিষ্পত্তি হোক। অন্য ট্রাকগুলো পরে পাঠান।

তিনি আরও বলেন, ২৮ মার্চ মামলার পর ৩০ মার্চ আমাকে চিঠি দিয়ে ব্যাখ্যা দাবি করা হয়েছে। টিএসপিসিএলের এ পদক্ষেপ বেআইনি। যে ট্রাকগুলোর সার আত্মসাৎ করার কথা বলে হয়েছে, সেগুলো যশোর বাফার গোডাউনের আশপাশে রয়েছে।

আটক পাঁচ ট্রাক থেকে সংগৃহীত নমুনা দুই দফার পরীক্ষায় ভেজাল পাওয়ার পরেও ‘এসব সারে ভেজাল নেই’ বলে দাবি করেন ঠিকাদার।

প্রতি কেজি টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) সার উৎপাদনে ব্যয় হয় ৬৬ টাকা। তবে কৃষকদের কাছে সরকারিভাবে ভর্তুকিমূল্যে প্রতি কেজি ২০ টাকা করে বিক্রি করা হয়।