ভ্যাট কমানোসহ নানান পদক্ষেপেও ভোজ্যতেলের লাগাম টানতে পারছে না সরকার। রমজানের শুরুতেই এক প্রকার ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়েছে ভোজ্যতেলের বাজার। দেশে ভোগ্যপণ্যের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে সপ্তাহের শুরুতেই প্রতি মণ পাম অয়েল ও সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ৫০০-৭০০ টাকা। আবার দাম বাড়ার অজুহাতে খাতুনগঞ্জের অনেক বড় ব্যবসায়ী শনিবার থেকে অলিখিতভাবে ভোজ্যতেল কেনাবেচাও বন্ধ রেখেছেন। তবে ভোজ্যতেলের এ দ্বিচারিতার মধ্যে মসলাসহ অন্যসব পণ্যের বাজার নিম্নমুখী বলছেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা।

খাতুনগঞ্জের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি মণে ৫০০ টাকারও বেশি বেড়েছে পাম অয়েলের দাম। গত রোববার প্রতি মণ পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে পাঁচ হাজার ২০০ টাকায়। সেখানে চলতি সপ্তাহের শনিবার ও আজ (রোববার) প্রতি মণ পাম অয়েলের বাজারমূল্য পাঁচ হাজার ৭০০ টাকা। একইভাবে গত রোববার সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছিল প্রতি মণ ছয় হাজার টাকায়। সেখানে গতকাল (শনিবার) সন্ধ্যা থেকে আজ রোববার (৩ এপ্রিল) সকাল পর্যন্ত সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ছয় হাজার ৭শ টাকায়। অথচ পাম অয়েলের সরকারি মূল্য প্রতি মণ পাঁচ হাজার ১৮০ টাকা এবং সয়াবিন পাঁচ হাজার ৫৫০ টাকা।

এদিকে, ভোজ্যতেলের বাজার অস্থির হওয়ার কারণে খাতুনগঞ্জের অনেক বড় ব্যবসায়ী তেল কেনাবেচা বন্ধ করে দিয়েছেন।

অন্যদিকে সরকারি দামে ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে বলে দাবি করেছেন খাতুনগঞ্জের তেল-চিনির আরেক বড় ব্যবসায়ী মেসার্স আহাদ ট্রেডিংয়ের কর্ণধার আবুল বশর।  তিনি বলেন, আমরা সরকারি দরে ভোজ্যতেল বিক্রি করছি। কোনো দাম বাড়তি নেই। কিন্তু বাজারে কোনো ক্রেতা নেই। তাই তেলের কেনাবেচাও নেই।

তিনি বলেন, ভোজ্যতেলের দাম কমাতে সরকার নানান পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারি পদক্ষেপের কারণে এখন বেশি দামে তেল বিক্রি হচ্ছে না।

তবে বিপরীত বক্তব্য পাওয়া যায় ডিও ক্রেতাদের কাছ থেকে। ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম  বলেন, শনিবার বিকেল থেকে প্রতি মণ পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে পাঁচ হাজার ৭শ টাকায়। আবার কিনতে গেলে পাওয়াও যাচ্ছে না। সয়াবিনের দামও তিন-চারদিনের ব্যবধানে মণপ্রতি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা বেড়েছে।

এ বিষয়ে রোববার দুপুরে (৩ এপ্রিল) চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের সঙ্গে কথা হয় । তিনি বলেন, ভোজ্যতেলসহ অন্য পণ্যের বাজার সম্পর্কে তথ্য নিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি টিম খাতুনগঞ্জে পাঠানো হয়েছে। যদি সরকারি দরের চেয়ে বেশি মূল্য পাওয়া যায় তাহলে দু-একদিনের মধ্যেই অভিযান চালানো হবে।

খাতুনগঞ্জে ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। অথচ বছরের প্রথম সাড়ে ৮ মাসেই এর চেয়ে বেশি ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে দেশে।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি (২০২১-২০২২) অর্থবছরের প্রথম সাড়ে ৮ মাসে ২৪ লাখ ৪৬ হাজার ৪৭ টন অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে শেষ আড়াই মাসে আমদানি হয়েছে তিন লাখ ৫৮ হাজার ৮০০ টন। এসব ভোজ্যতেলের বেশিরভাই আমদানি করেছে দেশের শীর্ষ পাঁচ শিল্প গ্রুপ।

ভোজ্যতেল বাদে খাতুনগঞ্জের বাজারে অন্যসব পণ্যের দাম কমতির দিকে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। যেহেতু রোজা শুরু হয়েছে, ফলে অনেকেই রমজানের প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে ফেলেছেন। এ কারণে এখন সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম কমে যাবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, চাহিদার চেয়ে বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের জোগান বেশি। তবে খেসারিসহ কিছু অপ্রচলিত পণ্যের দাম কয়েকদিনে সামান্য বেড়েছে বলে জানান তারা।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোববার প্রতিমণ চিনি বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ৬৪৫ টাকার মধ্যে। গত বৃহস্পতিবার চিনির দাম আরও ১৫-২০ টাকা বেশি ছিল।

মেসার্স আহাদ ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী আবুল বশর  বলেন, চিনিসহ সব ধরনের পণ্যের দাম কমছে। রমজান শুরু হওয়ায় এখন দাম শুধু কমতে থাকবে।

একইভাবে ছোলা, মটর ডাল, মসুরের ডালের দাম কমছে। তবে খেসারি ডালের দাম কিছুটা বেড়েছে। ডাল আমদানিকারক ও চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন  বলেন, খাতুনগঞ্জে আগের ব্যবসা নেই। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওজন স্কেলের কারণে দূর-দূরান্তের জেলার ব্যবসায়ীরা এখন খাতুনগঞ্জে আসেন না। যে কারণে আগের তুলনায় ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক কম। বর্তমানে খাতুনগঞ্জে ছোলা, মটর, মসুর, খেসারিসহ সব পণ্যের পড়তা (আমদানি পর্যায়ের সব ধরনের খরচ যুক্ত করে ক্রয়মূল্য) বেশি।

তিনি বলেন, পড়তা বেশি হলেও গত এক সপ্তাহে দাম কমেছে। মাঝারি মানের ছোলা প্রতিকেজি ৫৯-৬০ টাকায় এবং ভালো মানের ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও কেজিতে ২-৩ টাকা বেশি ছিল। একইভাবে মসুর ডাল ৮৮ টাকা, মটর ৪৫ টাকা প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে।

মো. মহিউদ্দিন আরো বলেন, রোজা শুরুর দুয়েকদিন আগে থেকে খেসারির দাম কিছুটা বেড়েছে। রোববার প্রতিকেজি খেসারি ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়। মাঝে কয়েকদিন ৫৫ টাকায় নেমেছিল। ওই সময়ে দাম কমে যাওয়ায় অনেকেই এলসি খোলেননি (আমদানি করেননি)। তাই বাজারে খেসারি শর্ট (জোগান কম) আছে। এজন্য দাম কিছুটা বেড়েছে।

কয়েকদিন পর আবার কমে যাবে বলে দাবি করেন এই ব্যবসায়ী।

এদিকে রমজান শুরু হতেই খাতুনগঞ্জে চাঙা হয়েছে গরম মসলার বাজার। তবে দাম বাড়েনি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। গরম মসলা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারে ভারতীয় জিরা (চিকন জিরা) বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৩৫৫ টাকা। এক সপ্তাহ ধরে এ জিরা ৩৫০ টাকা থাকলেও এক মাস আগে ছিল প্রতিকেজি ৩৭০ টাকা। বাজারে আফগানিস্তানের জিরা বিক্রি হচ্ছে ৩৮৫ টাকা প্রতিকেজি। গত সপ্তাহে একই জিরা ৩৯০ টাকা এবং এক মাস আগে ৪০০ টাকা বিক্রি হয়। গুয়েতেমালা থেকে আমদানি করা এলাচ দিয়েই আমাদের দেশে চাহিদা মেটানো হয় বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তবে মানভেদে বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড রয়েছে এলাচের। রোববার এলএমজি ব্র্যান্ডের প্রতিকেজি এলাচ বিক্রি হয় এক হাজার ৪২০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগেও এ এলাচের দাম ছিল এক হাজার ৪৮০ টাকা। জেবিসি ব্র্যান্ডের এলাচ বিক্রি হয় এক হাজার ৪৫০ টাকা প্রতিকেজি। এক সপ্তাহ আগে এ এলাচ বিক্রি হয় এক হাজার ৪৮০ টাকায়।

একইভাবে চায়না থেকে আসা দারুচিনি প্রতিকেজি ২৯২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছিল ২৯৫ টাকায়। ভিয়েতনাম থেকে আসা দারুচিনি প্রতিকেজি ৩৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে এ দারুচিনির দাম কেজি প্রতি ৫ টাকা কম ছিল। তাছাড়া ইন্দোনেশিয়ার লবঙ্গ বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৯৭৫ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে লবঙ্গের দাম ছিল প্রতিকেজি ৯৯০ টাকা।

মসলা ব্যবসায়ী মো. বাদশাহ  বলেন, জিরা, এলাচ ও দারুচিনি নিয়ে মসলার বাজারে মাতামাতি বেশি হয়। সরকারিভাবেও এই তিনটি মসলার বাজার মনিটরিং করা হয়। এখন বাজারে মসলা বেচাকেনা বেড়েছে। দাম তেমন উঠতি-পড়তি নেই।

তবে কোরবানির সময় মসলার বাজার চড়া হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

একইভাবে খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের পাইকারি বাজারে লাগাতার কমছে পেঁয়াজ-রসুনের দাম। দেশে পেঁয়াজের মৌসুম হওয়ার পাশাপাশি ভারত থেকে বেশি আমদানি হওয়ায় দাম কমছে। ব্যবসায়ীদের দাবি কস্টিংয়ের (পরিবহন খরচসহ আমদানিমূল্য) চেয়ে বাজারমূল্য কম। পেঁয়াজ-রসুন আমদানি করে সম্প্রতি আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে মনে করছেন মধ্যম চাক্তাইয়ের আড়তদার বশর অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী আবুল বশর।  তিনি বলেন, রোববার ভারতীয় খাসখালি ও মেহেরপুর জাতের পেঁয়াজ প্রতিকেজি ১৬-১৮ টাকায় এবং নাসিক জাতের পেঁয়াজ ২৩-২৪ টাকায় বিক্রি হয়। দেশি রসুন প্রতিকেজি ২০ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

চায়না রসুন বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৯০-৯২ টাকায়। একইভাবে আদা ৬৮-৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এ মূল্য আমদানি পর্যায়ের মূল্যের চেয়েও কম বলে দাবি করেন এ ব্যবসায়ী।