রাজধানীর শাহজাহানপুরে গুলিতে নিহত মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে দুবাই বসে হত্যার পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দেন সুমন শিকদার ওরফে মুসা। টিপু হত্যাকাণ্ডের ঠিক ১২ দিন আগে দুবাই চলে যান মুসা। দুবাই বসে হত্যার পুরো ছক কষেন তিনি। টিপুকে হত্যায় চুক্তি হয় ১৫ লাখ টাকা। এই ১৫ লাখ টাকা কে কত দেবে তাও ভাগ করে দেন মুসা। নয় লাখ টাকা দেন ওমর ফারুক। অবশিষ্ট ছয় লাখ টাকা দেন গ্রেফতার নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির, আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ ও মুসা।
শনিবার (২ এপ্রিল) দুপুরে কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।
তিনি জানান, দুবাই যাওয়ার আগে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে যান মুসা, হুন্ডির মাধ্যমে আরও চার লাখ টাকা মুসাকে দেওয়া হয়। বাকি ছয় লাখ টাকা দেশে হস্তান্তর করার চুক্তি হয়। ছয় লাখের মধ্যে র্যাব গ্রেফতারের সময় তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা জব্দ করে। দুবাই থাকা মুসা ২০১৬ সালে রিজভী হাসান হত্যাকাণ্ডের চার্জশিটভুক্ত ৩ নম্বর আসামি।
এর আগে রাতে র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৩ এর অভিযানে গত রাতে রাজধানীর মুগদা, শাহজাহানপুর ও মিরপুর এলাকা থেকে ঘটনার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ওমর ফারুক (৫২) ও পরিকল্পনায় সম্পৃক্ত, আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ (৩৮), মো. নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির (৩৮) এবং মো. মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশকে (৫১) গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে নজরদারির কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা ও মোবাইলসহ অন্যান্য সামগ্রী উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতারদের বরাতে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, হত্যাকাণ্ডটি দেশে ঘটলেও নিয়ন্ত্রণ করা হয় দুবাই থেকে। দেশে থাকা নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির, মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশসহ আরও কয়েকজন জাহিদুল ইসলাম টিপুর অবস্থান সম্পর্কে বেশ কয়েকদিন ধরে মুসার কাছে তথ্য প্রেরণ করতেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর গ্রেফতার নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির আনুমানিক চারবার জাহিদুল ইসলাম টিপুর অবস্থান সম্পর্কে মুসাকে অবহিত করেন। পরে জাহিদুল ইসলাম টিপু গ্রান্ড সুলতান রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় গ্রেফতার মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশ তাকে নজরদারিতে রাখেন এবং তার অবস্থান সম্পর্কে ফ্রিডম মানিককে অবহিত করেন। টিপুর অবস্থান সম্পর্কে জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টার দিকে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের তত্ত্বাবধানে কিলার কর্তৃক হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, গ্রেফতার ওমর ফারুকের সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের জন্য ১৫ লাখ টাকার চুক্তি হয়। ওই ১৫ লাখ টাকা রিজভী হাসান হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামিদের মধ্যে ওমর ফারুক ৯ লাখ এবং অবশিষ্ট টাকা নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির, আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ ও মুসা দেন। দুবাইয়ে যাওয়ার সময় মুসা পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে যান ও হুন্ডির মাধ্যমে মুসাকে আরও চার লাখ টাকা পাঠানো হয়। অবশিষ্ট ছয় লাখ টাকা দেশে হস্তান্তর করার চুক্তি হয়।
ডিবির হাতে গ্রেফতার শুটার মাসুম ও দামালের এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, হত্যাকাণ্ডটি কাটআউট পদ্ধতিতে করা হয়। যেখানে গ্রেফতার নাছির ও ওমর ফারুকের কাছে পরিকল্পনার তথ্য রয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা মুসাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। মুসা সমন্বয়কারী হিসেবে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সমন্বয় করেছেন ও কিলার নিয়োগ করেন। যেহেতু আমরা মুসাকে গ্রেফতার করতে পারিনি এবং তিনি দুবাই চলে গেছেন, তাই কাকে তিনি আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাধ্যমে শ্যুটার নিয়োগ করেছিলেন সেটা মুসাকে গ্রেফতারের পর জানা যাবে। গ্রেফতার নাছির, ওমর ফারুক ও সালেহর কাছ থেকে আমরা কোনো শ্যুটার বা কিলারের নাম পাইনি।
দুবাইয়ে অবস্থানরত আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই সন্ত্রাসী কে জানতে চাইলে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, এখানে আমরা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সন্ত্রাসীর নাম পেয়েছি। আমরা মুসার অবস্থান পেয়েছি দুবাইতে। সেখানে তিনি আন্ডারওয়ার্ল্ডের এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। একইভাবে কাইল্লা পলাশ একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে এই হত্যাকাণ্ডের তথ্য দিচ্ছিলেন, যার অবস্থান পার্শ্ববর্তী একটি দেশে। আবার মুসা এর আগে কিলিংমিশনে একজন কিলার নিয়েছিলেন, সেখানে আন্ডারওয়ার্ল্ডের একজন সন্ত্রাসীর নাম আমরা পেয়েছি, তার অবস্থান আমরা পাচ্ছি ফ্রান্সে। এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এ দেশে অবস্থান করে ভিপিএনের মাধ্যমে আরেক দেশের নম্বর দিয়ে কল করা যায়। এখন এই ঘটনায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে, নাকি তারা সরাসরি জড়িত সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। শুধু আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসী নয়, আন্ডারগ্রাউন্ডের কিছু সন্ত্রাসীর নামও আমরা পেয়েছি। যাদের অনেককেই আমরা গ্রেফতার করেছি। তাদেরও এই হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। কোনোকিছুই আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। সে বিষয়েও তদন্ত চলমান।
আরেক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেফতার নাছির জানিয়েছেন মুসার সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ হয়েছিল। কীভাবে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবে, সেটি মুসা নাছিরকেই জানিয়েছিলেন।
নাছির আরও জানিয়েছেন, পরিকল্পনায় কিলারের পাশাপাশি ব্যাকআপ প্ল্যানও ছিল। এ কথা মুসাই তাদের জানিয়েছেন। যখন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তখন নাছির ঘটনাস্থলের কাছাকাছি ছিলেন। তিনি মুসাকে জানিয়েছেন ‘ইট ইজ ডান’। এতে মুসার আর ব্যাকআপ প্ল্যানের প্রয়োজন হয়নি।
মুসাকে দুবাই থেকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মুসার অবস্থান শনাক্ত করার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে শেয়ার করা হচ্ছে। দুবাইতে তিনি কোথায় কী অবস্থায় আছেন সে সম্পর্কে কিছু তথ্য আমরা পেয়েছি। সেসব তথ্য পুলিশ সদরদপ্তরের মাধ্যমে যেসব সংস্থাকে দেওয়া প্রয়োজন ও যে মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব সেসব কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে। কারণ তাকে না পাওয়া গেলে টিপু হত্যার পুরো পরিকল্পনা সম্পর্কে জানা কঠিন।
গত ২৪ মার্চ রাত সোয়া ১০টার দিকে রাজধানীর শাহজাহানপুরে ইসলামী ব্যাংকের পাশে বাটার শোরুমের সামনে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসময় গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা সামিয়া আফরান প্রীতি (১৯) নামে এক কলেজছাত্রীও নিহত হন। এছাড়া টিপুর গাড়িচালক মুন্না গুলিবিদ্ধ হন।
চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের পর ওইদিন রাতেই শাহজাহানপুর থানায় নিহত টিপুর স্ত্রী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সংরক্ষিত কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। এতে অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়।