‘প্রতি হাজার ইটের দাম ২ হাজার টাকা, রডের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ বাড়তি, সিমেন্টের দাম বেড়েছে বস্তায় ৭০-৮০ টাকা। ঠিকাদাররা তো আর বাড়ি থেকে টাকা এনে উন্নয়ন কাজ করতে পারবে না। তাই তো থেমে গেছে নগরীর উন্নয়নে হাজার কোটি টাকার কাজ।’
এভাবেই হতাশা প্রকাশ করে কথাগুলো বললেন খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এস এম মোজাফ্ফার রশিদী রেজা।
নগরীর টুটপাড়া কবরখানা এলাকার আতিক স্টিল করপোরেশনের মালিক মো. রফিক বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রড-সিমেন্টের দাম বাড়তে শুরু করে। বর্তমানে সর্বকালের সর্বোচ্চ দাম চলছে। রড-সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, বহির্বিশ্বে এ শিল্পের কাঁচামালের সংকটের কারণে দাম বেড়েছে। তারা বলছেন, দাম আরও বাড়বে।
এদিকে, খুলনা সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, নগরীর টুটপাড়া জোড়াকল বাজার থেকে সাহেবখালী খাল পর্যন্ত ড্রেনসহ ফুটপাত নির্মাণের জন্য প্রথম দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০২১ সালের ৮ জুন। এরপর গত ২৪ জানুয়ারি দ্বিতীয়বার ও ২৩ ফেব্রুয়ারি তৃতীয়বার দরপত্র আহ্বান করা হয়। একবারও দরপত্র জমা পড়েনি। প্রায় তিন কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ড্রেন নির্মাণের জন্য চতুর্থবার দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া নগরীর সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকায় সোলার পার্কের পাশে ড্রেন নির্মাণের জন্য দুই দফা দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। চার কোটি ৫৬ লাখ টাকার এই কাজে একবারও অংশ নেননি কোনো ঠিকাদার।
শুধু এ দুটি কাজই নয়, গত এক মাসে নগরীর বিভিন্ন স্থানে ড্রেন নির্মাণ ও সড়ক সংস্কারের জন্য নয়টি দরপত্রে কোনো ঠিকাদার অংশ নেননি। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি খাল খনন ও ড্রেন সংস্কারের জন্য ১৬টি দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আগামী ৩০ মার্চ দরপত্র জমার শেষ দিন। এসব কাজে কেসিসির নিয়মিত ঠিকাদাররা অংশ নিচ্ছেন না।
এদিকে, নগরীর ৩১টি ওয়ার্ডে ৬১টি সড়ক ও ড্রেনের সংস্কার কাজ চললেও নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব কাজে গতি কমে গেছে। অনেকে মাঝপথে কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। বর্তমানে প্রায় হাজার কোটি টাকার কাজ বন্ধ আছে। এতে দুর্ভোগ বেড়েছে নগরীর মানুষের।
নগরীর বড় বাজার এলাকার জুয়েল এন্টারপ্রাইজের মালিক নেয়ামত হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সিমেন্ট উৎপাদনের প্রধান উপকরণ ক্লিঙ্কারের দাম বেড়ে গেছে। এজন্য কোম্পানিগুলো দাম বাড়িয়েছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিবস্তায় ২০ টাকা করে বেড়েছে।
রড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান জিপিএইচ খুলনার মার্কেটিং ম্যানেজার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, দেড়মাস ধরে রডের দাম বাড়ছে। রড নির্মাণের প্রধান উপকরণ হচ্ছে স্ক্র্যাপ ও বিলেট। এগুলো মূলত: ইউরোপ থেকে আসে। বহির্বিশ্বে এ উপকরণটির দাম প্রচুর বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন তাদের তিন হাজার মেট্রিক টন রডের চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে কতটা উৎপাদন হচ্ছে তা তিনি জানেন না। অস্থির হয়ে আছে রডের বাজার। তবে বেশিদিন এ অবস্থা থাকবে না।
খুলনা সিটি করপোরেশনের ঠিকাদার মনিরুল ইসলাম বাবু জানান, তিনি নগরীর বয়রা বাজার এলাকার একটি ড্রেন নির্মাণের কাজ করছিলেন। গত কয়েকদিন সেখানে কাজও করেছেন। রড ও সিমেন্টের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার কারণে সেখানকার কাজ তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। এত উচ্চমূল্যে রড ও সিমেন্ট কিনে কাজ করতে গেলে তার অনেক ক্ষতি হবে।
তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত দেখিয়ে রড ও সিমেন্টের দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর আগের উৎপাদিত রডগুলো কোথায় গেলো? তিনি সরকারকে এ শিল্পের প্রতি নজর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। না হলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো থেমে যাবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
কেসিসির পূর্ত বিভাগ থেকে জানা গেছে, বর্তমানে নগরীতে ৮২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং ৬০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে রাস্তা উন্নয়ন ও পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে রাস্তা সংস্কার প্রকল্পের আওতায় নগরীর ৩১টি ওয়ার্ডে প্রায় ৩২২ কোটি টাকার কাজ চলছে। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে ১২৮ কোটি টাকার কাজ চলছে। নতুন দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে আরও ১০০ কোটি টাকার। এছাড়া সড়ক বিভাগ, কেডিএ, গণপূর্ত বিভাগের আরও পাঁচশ কোটি টাকার কাজ চলছে। নিমার্ণসামগ্রীর দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে এসব কাজে।
সূত্র জানায়, কেসিসির ৮২৩ কোটি ও ৬০৭ কোটি টাকার প্রকল্প দুটি অনুমোদন হয়েছে ২০১৮ সালে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের ২০১৮-১৯ সালের দর অনুযায়ী প্রকল্প দুটি অনুমোদন পায়। এ কারণে দরপত্র আহ্বান করতে হচ্ছে তিন বছরের আগের দর অনুযায়ী। বর্তমানে বাজারদর এর চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি।
কেসিসির উন্নয়নকাজের দরপত্রে দেখা গেছে, ৬০ গ্রেডের প্রতি কেজি রডের দাম ধরা হয়েছে ৬৭ টাকা। ২০ মিলিমিটার পাথরের দাম প্রতি ঘনফুট ১৭৫ টাকা, ১২ মিলিমিটার ১৬৪ টাকা, প্রতি ব্যাগ সিমেন্ট ৪০০ টাকা।
মঙ্গলবার (২২ মার্চ) খুলনার বাজারে প্রতি কেজি রড ৮৯ থেকে ৯২ টাকা, পাথর ২২৫ থেকে ২৩০ এবং সিমেন্ট বিক্রি হয়েছে প্রতি ব্যাগ ৪৮০ টাকা।
কেসিসির ঠিকাদার কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক তসলিম আহমেদ আশা বলেন, বেশি দামে রড-সিমেন্ট কিনে কাজ করলেও বিল পাবেন কেসিসির দর অনুযায়ী। প্রতিটি উপকরণে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত লোকসান হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ছোট অনেক ঠিকাদার পথে বসে গেছেন। লোকসানের ভয়ে কেউ নতুন দরপত্রে অংশ নিচ্ছেন না।
কেসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মশিউজ্জামান খান বলেন, ২০১৮-১৯ সালের দরে প্রকল্প পাস হয়েছে। এখন নির্মাণসামগ্রীর দর বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, ড্রেনের কাজের নতুন দরপত্রে কেউ অংশ নিচ্ছে না। চলমান কাজও ঠিকাদাররা করতে চাইছেন না। প্রায় হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ বন্ধ রয়েছে।
জানতে চাইলে কেসিসি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক বলেন, সরকারি দর বাড়াতে হলে প্রকল্প সংশোধন করতে হবে। স্থানীয় সরকারমন্ত্রীকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা।