সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয়নি গত তিন বছর। বদলি কার্যক্রমও স্থগিত। বারবার সময় ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে নিয়োগ-বদলি শুরু হয়নি কোনোটিই। বাধা ছিল মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা। তবে প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে মার্চে শিক্ষক বদলি ও এপ্রিলে নিয়োগ পরীক্ষা আয়োজনে নতুনভাবে প্রস্তুতি শুরু করা হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)।
ডিপিই থেকে জানা যায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সারাদেশে ২৫ হাজার ৬৩০ জন প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষক এবং ৬ হাজার ৯৪৭টি শূন্যপদে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দিতে ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর অনলাইন আবেদন শেষ হয়। এরপর দুই ধাপে ভুল সংশোধন করার সুযোগ দেয় ডিপিই। নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণে মোট ১৩ লাখ পাঁচ হাজার প্রার্থীর আবেদন চূড়ান্ত করা হয়। তবে দেড় বছর পার হলেও এখনো নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা শুরু করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী একাধিকবার এ পরীক্ষা শুরুর সময় ঘোষণা করলেও বাস্তবে নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ।
শিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়োগ শাখার একজন কর্মকর্তারা জানান, এরই মধ্যে প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে শেষ করা হয়েছে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের কাজ। পরীক্ষার বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সঙ্গে হয়েছে চুক্তিও। পরীক্ষা আয়োজনে নিয়োগ পরিচালনা কমিটি একাধিক সভা করে সব প্রস্তুতিমূলক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধু পরীক্ষাকেন্দ্র চূড়ান্ত করা হলে পরীক্ষা শুরু করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, আমরা একাধিকবার নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করতে অনেক কাজ এগিয়ে রাখলেও মন্ত্রণালয়ের সম্মতি না থাকায় তা সম্ভব হয়নি। গত বছরের এইচএসসি পরীক্ষা শেষে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা শুরু করতে বলা হলেও করোনার কারণে তা বাতিল হয়ে যায়। বর্তমানে দ্রুত সময়ের মধ্যে লিখিত পরীক্ষা আয়োজন করতে গত সপ্তাহে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে কারণে আবারো নতুন করে শুরু হয়েছে প্রস্তুতি।
এপ্রিলের শেষ দিকে লিখিত পরীক্ষা শুরু করা হতে পারে বলে জানান তিনি।
জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আমিনুল ইসলাম বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা শেষ করতে চাই। সারাদেশে আমাদের অনেক বিদ্যালয় শিক্ষকশূন্য। প্রাক-প্রাথমিক স্তরের ৩৪ হাজার শিক্ষকসহ শূন্যপদে এ নিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষক নেওয়া হবে। দ্রুত এ কার্যক্রম শেষ করতে গত সপ্তাহে অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, তিন বছর ধরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা বদলি হতে পারছেন না। প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এ কার্যক্রম চললেও করোনা পরিস্থিতির কারণে তিন বছর ধরে তা স্থগিত। শিক্ষক বদলি নিয়ে নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি ও হয়রানির অভিযোগ থাকায় সেটি অনলাইনভিত্তিক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অনলাইন কার্যক্রমের আওতায় আনতে একটি সফটওয়্যার তৈরি করে ডিপিই। ঢাকার পার্শ্ববর্তী তিনটি উপজেলায় দুই বছর ধরে পাইলটিং শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।
শিক্ষক বদলির জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তদবির করেন। একই সঙ্গে অন্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিব, সংসদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ নানা মহলের সুপারিশ থাকে। অনলাইনে এ কার্যক্রম চালু হলে সেটা আর সহজ থাকবে না। অনলাইনে না আগের পদ্ধতিতে বদলি করা হবে সেটি নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরির এটাও কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক অনলাইন সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরিদ আহমেদ বলেন, শিক্ষকদের বদলি একটি অধিকার। এটা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। শিক্ষকের বাসার কাছে পদ খালি থাকলেও সেখানে যেতে পারছেন না। অনেক নারী শিক্ষক তার স্বামীর এলাকায় বদলি হয়েছেন। বর্তমানে কারও ডির্ভোস হয়ে যাওয়ায় তারা নিজ এলাকায় আসতে পারছেন না। প্রতিদিন নানা ধরনের প্রতিবন্ধতার মধ্যে তাকে সেখানে থাকতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকে পাঠদানে মনোনিবেশ করতে পারছেন না। বদলি হতে না পারায় কেউ আবার চাকরি ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনাও করছেন।
তিনি বলেন, প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত শিক্ষক বদলি কার্যক্রম শুরু করা হলেও তিন বছর ধরে এ কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। কর্মকর্তাদের অবহেলায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তাদের কারণে শিক্ষকরা ভুক্তভোগী হচ্ছেন। অনেকে জটিল রোগে আক্রান্ত, অনেকের স্বামী বা স্ত্রী অসুস্থ, অনেকের সন্তান অসুস্থ, অনেকে স্বামী এক জেলায় স্ত্রী আরেক জেলায় থাকছেন। বদলি হতে না পেরে অনেকের জীবন ঝুঁকিতে।
এসব কারণ বিবেচনায় নিয়ে শিগগির শিক্ষক বদলি কার্যক্রম চালুর দাবি জানান এই শিক্ষক নেতা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপিইর মহাপরিচালক মনসুরুল আলম বলেন, ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষক বদলি শুরু করতে আমাদের সফটওয়্যারের কাজ প্রায় শেষ। এ কার্যক্রম পাইলটিং করতে প্রতিমন্ত্রী সময় দিলেও পরে তা শুরু করা সম্ভব হয়নি। মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দিলেই আমরা এক সপ্তাহে পাইলটিং কাজ শেষ করে পুরোপুরি শুরু করতে পারবো।
জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেন, প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে শিক্ষক বদলি শুরু করা হলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে তিন বছর ধরে তা স্থগিত রাখা হয়েছে। বর্তমানে এ কার্যক্রম ডিজিটাল পদ্ধতিতে করতে একটি সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে। চলতি মাস থেকে বদলির জন্য শিক্ষকদের অনলাইন আবেদন কার্যক্রম শুরু করা হবে। তবে শুরু অনলাইনে না অফলাইনে হবে সে বিষয়ে এখানো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।