অনুমোদনসাপেক্ষে সুগন্ধি চাল রপ্তানির সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশে। কোনো প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখালে রপ্তানি আদেশ অনুযায়ী বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কেস টু কেস ভিত্তিতে এই অনুমোদন দেয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাড়ছে সুগন্ধি চাল রপ্তানি। এক যুগে রপ্তানি বেড়েছে ১০ গুণের বেশি। গত দুই বছরে যা ছুঁয়েছে ১০ হাজার টনের মাইলফলক।

জানা যায়, বিদেশে চাল রপ্তানি করতে হলে মানের একটি ছাড়পত্র নিতে হয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উইং থেকে। সে উইংয়ের তথ্য বলছে, দেশ থেকে গত অর্থবছর (২০২০-২১) ৯ হাজার ৫১৭ টন সুগন্ধি চাল বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। আগের অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৮৭৯ টন। এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫ হাজার ৮০৫ টন এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮ হাজার ২১০ টন চাল রপ্তানি হয়।

গত এক দশক ধারাবাহিকভাবে সুগন্ধি চালের রপ্তানি বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মাত্র ৬৬৩ টন সুগন্ধি চাল রপ্তানি করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। যেটা বেড়ে প্রায় ১১ হাজার টন ছুঁয়েছে।

সুগন্ধি চাল রপ্তানির ক্ষেত্রে রপ্তানি নীতি ২০১৮-২০২১ অনুসরণ করতে হয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে। সে নীতি অনুযায়ী, রপ্তানিযোগ্য সুগন্ধি চাল স্বচ্ছ (ট্রান্সপারেন্ট) প্যাকেটে প্যাকেটজাত করে পাঠাতে হয় বিদেশে। শুল্ক কর্তৃপক্ষ রপ্তানিপণ্যের বেশ কয়েকটি পরীক্ষা করে। যার একটি হয় সঙ্গনিরোধ উইংয়ে।

সঙ্গনিরোধ উইংয়ের পরিচালক রঞ্জিৎ কুমার পাল বলেন, এখন বিদেশে চাল রপ্তানিতে আগ্রহ অনেক বেশি। কারণ বিদেশে এ চালের বড় বাজার রয়েছে। বিশেষ করে যেসব দেশে বাঙালি ও পাকিস্তানিরা রয়েছে সেসব দেশে চাল বেশি যাচ্ছে।

‘বহির্বিশ্বে এক সময় পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভারতের লম্বা-সরু বাসমতি চালের একচেটিয়া বাজার ছিল। পাশাপাশি বাংলাদেশি সুগন্ধি চালও এখন জায়গা করে নিয়েছে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রধানত দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুর, নওগাঁ, রাজশাহী জেলায় সুগন্ধি ধান উৎপাদন হচ্ছে। চাহিদার কারণে গত কয়েক বছরে উৎপাদন অনেক বেড়েছে। প্রধানত আমন মৌসুমে (খরিফ-২) সুগন্ধি ধানের চাষ করা হয়। এ মৌসুমে উৎপাদিত ধানের প্রায় ১০ শতাংশ সুগন্ধি জাত।

অন্যদিকে অন্যান্য ধানের তুলনায় বিক্রয়মূল্য বেশি হওয়ায় সুগন্ধি ধানের আবাদে ঝুঁকছেন কৃষকরা। ফলে কয়েক বছরে দেশে সুগন্ধি ধানের আবাদে এসেছে বড় পরিবর্তন।

দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার পাশাপাশি রপ্তানি বেড়ে যাওয়ায় সুগন্ধি চালের বড় বাজার সৃষ্টি হয়েছে। এই বাজারে এখন বিনিয়োগ করছে বড় বড় প্রতিষ্ঠান। এ তালিকায় রয়েছে প্রাণ, এসিআই, ইস্পাহানি, স্কয়ারসহ বিভিন্ন কোম্পানি। দেশেও তারা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সুগন্ধি চাল বিক্রি করছে। পাশাপাশি চাল প্রক্রিয়াজাতকরণেও বড় বিনিয়োগ করেছে তারা।

বিভিন্ন জেলায় অঞ্চলভিত্তিক প্রচুর সুগন্ধি ধানের জাত আছে। জাতগুলোর মধ্যে অধিকাংশই অতি সুগন্ধি। এ জাতগুলো প্রধানত চিনিগুঁড়া, কালিজিরা, কাটারিভোগ, তুলসীমালা, বাদশাভোগ, খাসখানী, বাঁশফুল, দুর্বাশাইল, বেগুন বিচি, কাল পাখরী অন্যতম। এছাড়া হালকা সুগন্ধিযুক্ত জাতগুলোর মধ্যে পুনিয়া, কামিনী সরু, জিরাভোগ, চিনি শাইল, সাদাগুঁড়া, মধুমাধব, গোবিন্দভোগ, দুধশাইল বেশ জনপ্রিয়। এসব চাল প্যাকেটজাত করে বিদেশে রপ্তানি করছে কোম্পানিগুলো।

রপ্তানিকারকরা জানান, এখন পর্যন্ত ইতালি, কুয়েত, লন্ডন, আমেরিকা, ফ্রান্স, কানাডা, জর্ডান, ওমান, অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, জাপান, সিঙ্গাপুরসহ প্রায় ১৩৬টি দেশে সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়েছে। তবে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে ২৮টি দেশে। ওইসব দেশের প্রবাসী বাংলাদেশি ও ভারত-পাকিস্তানের মানুষ এ চালের প্রধান ক্রেতা।

দেশের মতো বিদেশেও প্রধানত পোলাও, বিরিয়ানি, কাচ্চি, জর্দা, ভুনা-খিচুড়ি, ফিরনি, পায়েসসহ নানান পদের সুস্বাদু ও দামি খাবার তৈরিতে সুগন্ধি চাল বেশি ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়া বিয়ে, পূজা-পার্বণ, সেমিনার, ওয়ার্কশপসহ সব ধরনের অনুষ্ঠানে সুগন্ধি চালের ব্যবহার অতি জনপ্রিয়।

বিদেশে এই চালের বাজার আরও বাড়ানো যেত বলে মনে করেন বাংলাদেশ রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. শাহ আলম। তিনি বলেন, ‘রপ্তানির বাজার আরও বাড়ানো যেত। কিন্তু কখনো খোলা, কখনো বন্ধ থাকার কারণে বাজার হারাচ্ছি আমরা।’

‘আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী ভারত ও পাকিস্তান। তাদের একটা বাজার এরই মধ্যে তৈরি করা রয়েছে। আমাদের দেশে চালের উৎপাদন খরচ ওইসব দেশের চেয়ে বেশি। এ কারণে রপ্তানিতে আবারও ভর্তুকি পাওয়া গেলে তাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।’

শাহ আলম বাবু বলেন, এখন দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হচ্ছে সুগন্ধি চাল। রপ্তানির ক্ষেত্রে আগাম অনুমোদন ব্যবস্থা তুলে নিলে এ খাত থেকে রপ্তানি আয় আরও বাড়বে। রপ্তানি বাড়লে চাষিরা ভালো দাম পাবেন।