# বাংলাবান্ধা হয়ে প্রতিবেশী চারটি দেশের মধ্যে রেলসংযোগ স্থাপন করতে চায় বাংলাদেশ।
# প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রেলপথে স্বল্প সময়ে যাওয়া যাবে চীনসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে।
# মূল প্রকল্প শুরুর আগে রেলওয়ের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পসমূহের সম্ভাব্যতা যাচাই করছে সরকার।
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে রেলপথ যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। দুই দেশের মধ্যে চালু হচ্ছে আরও নতুন নতুন রেল সংযোগ। ফলে দুই দেশের মধ্যে গতিশীল হচ্ছে বাণিজ্য, যোগাযোগে পাচ্ছে নতুন মাত্রা। প্রতিবেশী অন্য দেশের সঙ্গেও এই সুবিধা পেতে কাজ করছে বাংলাদেশ। সে লক্ষ্যে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত হয়ে নেপাল, ভুটান ও চীনের সঙ্গে রেল সংযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার।
প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা রুটে ৫৭ কিলোমিটার নতুন ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মিত হবে। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে তিন হাজার ৭৫৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন এক হাজার ৩১৩ কোটি ২৪ লাখ এবং বৈদেশিক ঋণ দুই হাজার ৪৪০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত। বৈদেশিক ঋণের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ছাড়াও যে কোনো উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রকল্পের নীতিগত অনুমোদনের জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে। পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত নতুন ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণের পিডিপিপি (প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) নিয়ে এডিবির সঙ্গে অর্থায়নের বিষয়ে আলোচনা চলমান। শুধু এডিবি নয়, সহজ শর্তে প্রকল্প বাস্তবায়নে অন্য যে কোনো উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে দুই হাজার ৪৪০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা বৈদেশিক অর্থায়ন নেওয়া হবে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রেলপথে স্বল্প সময়ে যাওয়া যাবে চীনসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে। বাংলাবান্ধা থেকে ঢাকা আসতে যে সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে তার অর্ধেক সময়ে চীনে পৌঁছে দেবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ভারতে যেতে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট আর নেপাল ও ভুটানে যেতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগবে। এসব কারণে দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে ভারত, চীন, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে ভারত, নেপাল ও ভুটানের দূরত্ব খুবই কম। বাংলাবান্ধা থেকে কয়েকশ গজের মধ্যেই ভারত সীমান্ত। এই স্থলবন্দর থেকে নেপালের দূরত্ব মাত্র ৬১ কিলোমিটার। ভুটানের দূরত্ব মাত্র ৬৮ কিলোমিটার এবং চীন সীমান্ত মাত্র ২০০ কিলোমিটার। সম্ভাবনাময় এই বন্দরটি পাঁচটি বন্ধুপ্রতিম দেশকে একই সূত্রে আবদ্ধ করতে পারে। সেজন্যই বাংলাবান্ধা হয়ে চারটি দেশের মধ্যে রেল সংযোগ স্থাপন করতে চায় বাংলাদেশ সরকার।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পশ্চিম) অসীম কুমার তালুকদার বলেন, রেলপথ সবচেয়ে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী। রেলপথে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরিতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম উদ্যোগ পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত নতুন ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ। এই রেলপথ নির্মাণ করা হলে বাংলাবান্ধা দিয়ে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগে নতুন রুট তৈরি হবে। ভারতের সঙ্গে নেপাল ও ভুটানের রেলপথ রয়েছে। আমরা বাংলাবান্ধা দিয়ে ভারতকে সংযুক্ত করতে পারলে তখন অন্যান্য দেশের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ সৃষ্টি হবে। ভারতের রেলপথের বিভিন্ন পয়েন্ট যুক্ত হবে। আন্তর্জাতিক মালবাহী গাড়ি ও যাত্রীবাহী ক্যারেজ চলাচল করবে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে বর্তমানে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে মালামাল আমদানির পাশাপাশি ইমিগ্রেশন দিয়ে যাত্রীরা যাতায়াত করছেন। এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হয়ে সোনামসজিদ সীমান্ত পর্যন্ত ৩৭ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হবে। ফলে এটি বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে (বিবিআইএন) রেল সংযোগের অন্যতম রুট হবে। স্থলবন্দরটিতে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা গেলে যাত্রী পরিবহন ছাড়াও আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে মালামাল পরিবহন হবে সহজ ও সাশ্রয়ী।
মূল প্রকল্প শুরুর আগে রেলওয়ের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল জোনে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করছে সরকার। সমীক্ষা প্রকল্পটির বাস্তবায়ন মেয়াদকাল জুন ২০২২ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এই সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্পের অধীনে চারটি সমীক্ষা প্রকল্প করা হচ্ছে। যার মধ্যে পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অন্তর্ভুক্ত।
সমীক্ষা প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার পরই মূল প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। তার আগে বৈদেশিক অর্থায়ন প্রাপ্তির জন্য প্রকল্পের পিডিপিপি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে পাঠানো হয়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে সমীক্ষা প্রকল্প সম্পন্ন না করে দুই হাজার ৪৪০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা প্রকল্প সহায়তা নির্ধারণ করে বৈদেশিক অর্থায়নের জন্য চাওয়া ঠিক হবে না।
কাজের পরিধি
প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য নানা ধরনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম পরামর্শক সেবার সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিশদ নকশা। এছাড়া সম্ভাব্য সমীক্ষা, হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে, ম্যাথমেটিক্যাল মডেলিং, অর্থনৈতিক সমীক্ষা, পরিবেশগত সমীক্ষা, সামাজিক ও আবাসিক সেবা সমীক্ষাও করা হবে।
অ্যালাইনমেন্ট স্ট্যাডি
পরামর্শকের মাধ্যমে তিনটি বিকল্প অ্যালাইনমেন্ট প্রস্তুত করা হয়েছে। সর্বোত্তম উপযুক্ত অ্যালাইনমেন্ট হিসেবে সুপারিশ করা হয়েছে পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত রেলপথকে। সুপারিশ করা অ্যালাইনমেন্টের বিস্তারিত ট্রাপোগ্রাফিক ও হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে। এই সার্ভের ওপর ভিত্তি করে এবং অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে সুপারিশ করা অ্যালাইনমেন্ট চূড়ান্ত করা হয়। গ্রোথ সেন্টার, অর্থনৈতিক হটস্পট, জনসংখ্যার ঘনত্বের ওপর অনুশীলন করে পরামর্শকের মাধ্যমে স্টেশনের স্থান নির্ধারণ করে মোট নতুন পাঁচটি বি-ক্লাস স্টেশনের প্রস্তাব করা হয়েছে। স্টেশনগুলো হলো- পঞ্চগড়-জগদল, জগদল-ভোজনপুর, ভোজনপুর-তেঁতুলিয়া, তেঁতুলিয়া-ত্রিনয়হাট, ত্রিনয়হাট-বাংলাবান্ধা।
ট্রাফিক পূর্বাভাস
পরামর্শকের মাধ্যমে ৫০ বছরের ট্রাফিক পূর্বাভাস প্রস্তুত করা হয়েছে। বিদ্যমান ঢাকা-পঞ্চগড় রুটে ২০২০ সালে প্রতিদিন ১৭ হাজার ৮৪২ জন যাত্রী ভ্রমণ করতেন। মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে আমদানি করা মালামালের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ৯৬ হাজার ৮৬৯ মেট্রিক টন। এছাড়া রপ্তানি করা মালামালের পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ৬৩২ মেট্রিক টন এবং আয়ের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ১৫ লাখ টাকা।
প্রস্তাবিত পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা রুটে ২০২০ সালে দৈনিক চার হাজার ৭০৪ জন যাত্রী এবং তিন হাজার ২৪৯ টন মালামাল পরিবহন করা হয়। ২০৫৫ সালে এই পথে প্রতিদিন যাত্রী সংখ্যা হবে ১৫ হাজার ৭৮৯ জন এবং মালামাল পরিবহন হবে পাঁচ হাজার ১৪৯ টন। এসব অর্থনৈতিক কারণ বিবেচনা করে নতুন করে রুটটি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।
অপারেশন পরিকল্পনা
প্রস্তাবিত রেলপথ হবে ব্রডগেজ সিঙ্গেল লাইন ও ট্রেন আগমন এবং প্রস্থানের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে পার্বতীপুর জংশন স্টেশন। লালমনিরহাট থেকে আগত মিটারগেজ ট্রেন ও খুলনা থেকে আগত ব্রডগেজ ট্রেন পার্বতীপুর স্টেশন ব্যবহার করে গন্তব্যে আগমন-প্রস্থান করবে। অন্যদিকে দিনাজপুরের কাঞ্চন জংশনেও একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, বাংলাবান্ধা দিয়ে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হলে বাংলাদেশের রাজস্ব আয় বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি, চিকিৎসা ও ভ্রমণ বাড়বে। স্বল্প সময় ও কম খরচে যাতায়াত করতে পারবে সাধারণ মানুষ। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে চার দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপন হলে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হবে।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, বাংলাবান্ধা চার দেশের মধ্যে নিকটতম স্থলবন্দর। বাংলাবান্ধা দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ সৃষ্টি হলে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ লাভবান হবে। এখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে প্রচুর মানুষের। আমদানি-রপ্তানির অন্যতম স্পট হবে এটি। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হবে। সামগ্রিকভাবে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।