রেলকে আরও গতিশীল করতে ৭০টি মিটারগেজ রেল ইঞ্জিন কেনার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০১১ সালে চুক্তি হয় দক্ষিণ কোরিয়ান কোম্পানি হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে। তবে উভয়পক্ষের নানান জটিলতায় প্রকল্পের অগ্রগতি হয়নি বললেই চলে। একাধিকবার দরপত্র বাতিল করে কোরিয়ান কোম্পানিটি। প্রকল্পের মেয়াদও বাড়ে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ রেলের খরচ হয়েছে সোয়া পাঁচ কোটি টাকা। সবশেষ হুন্দাই রোটেম জানিয়েছে তারা ইঞ্জিনগুলো দিতে পারবে না। এখন অনিশ্চয়তায় প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ।
বর্তমানে বাংলাদেশ রেলের ইঞ্জিন আছে ২৮১টি। এর মধ্যে ১৮৬টি মিটারগেজ ও ৯৬টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন। এসব ইঞ্জিনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ২০ বছর। অথচ এরই মধ্যে ৩০ বছর অতিক্রম করেছে ১৬৮টি ইঞ্জিনের বয়স। পুরোনো এসব ইঞ্জিনের মধ্যে রয়েছে ১১০টি মিটারগেজ ও ৫৮টি ব্রডগেজ। মাত্রাতিরিক্ত মেরামত খরচ ও অধিক জ্বালানি খরচ করেই মেয়াদোত্তীর্ণ এসব রেল ইঞ্জিন চলমান রাখা হয়েছে।
এছাড়া মডেল অনেক পুরোনো হওয়ায় মেরামতের সময় প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশও মিলছে না অনেক ইঞ্জিনের। ফলে ইঞ্জিনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে রেলে। কোরিয়া থেকে ৭০টি ইঞ্জিন পাওয়ার সম্ভাবনা জাগাচ্ছিল নতুন আশা। কিন্তু প্রায় শেষ সময়ে কোম্পানি চুক্তি বাতিল করায় একদিকে সরকারের সোয়া পাঁচ কোটি টাকা যেমন গচ্চা গেলো, অন্যদিকে অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো প্রকল্পের ভবিষ্যৎ।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক আহমেদ মাহবুব চৌধুরী বলেন, প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে সোয়া পাঁচ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এখন সামনে কী করা যায় সবাই বসে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। চুক্তিটি দক্ষিণ কোরিয়ান কোম্পানিটি এরই মধ্যে বাতিল করেছে। এখন বাতিলের কাগজে সই করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। প্রকল্পের ভবিষ্যৎ এখন মন্ত্রী (রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন) যে সিদ্ধান্ত নেন তাই হবে।
১১ বছর প্রকল্পের কাজ চলমান রাখতে সোয়া পাঁচ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কোরিয়ান কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দেবে কি? এ প্রশ্নে প্রকল্প পরিচালক বলেন, কোরিয়ান কোম্পানি কোনো ক্ষতিপূরণ দেবে না। আমাদেরও ভুল আছে। কারণ আমরাও ফান্ড দিতে পারিনি।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলওয়ের জন্য ৭০টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেক্ট্রিক লোকোমোটিভ সংগ্রহ প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১১ সালের ১০ জুলাই। ২০২৪ সালের ৩০ জুন ৭০টি ইঞ্জিন দেওয়ার সময়সীমা ছিল। এজন্য মোট দুই হাজার ৬৭৯ কোটি ৯৫ লাখ ১০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল দক্ষিণ কোরিয়ান কোম্পানির (ইঞ্জিন সরবরাহকারী কোম্পানি হুন্দাই রোটেমের মাধ্যমেই কোরিয়ান সরকারের এ ঋণ দেওয়ার কথা ছিল)। ঋণের আন্তঃব্যাংক সুদের হার (লাইবর প্লাস) ১ দশমিক ৬০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। একপর্যায়ে কোম্পানিটির সঙ্গে ঋণের শর্ত নিয়ে ঝামেলা তৈরি হয় রেলের। সরকারি উৎস সংস্থানেও তৈরি হয় জটিলতা। ফলে অন্ধকারে চলে যায় ৭০টি রেল ইঞ্জিন কেনার উদ্যোগ।
প্রকল্পটি ২০১১ সালের ২৩ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদিত হয়। পরবর্তীসময়ে মেয়াদ ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়িয়ে সংশোধিত ডিডিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একনেকে অনুমোদিত হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ে জানায়, শুরু থেকে হুন্দাই রোটেম কোম্পানি একাধিকবার দরপত্র বাতিল করে। এর মধ্যে ২০২১ সালেই বাতিল করে চারবার। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে কোম্পানিটি চুক্তিমূল্য ১৬ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। তবে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে প্রস্তাবে ‘না’ জানানো হয়। পরবর্তীসময়ে একই বছর অর্থ বিভাগের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে সহজ শর্তে ঋণ চাওয়া হলেও প্রতিষ্ঠানটি তা দিতে সাড়া দেয়নি। ১৬ শতাংশ মূল্য না বাড়ানোয় হুন্দাই রোটেম ক্রয়চুক্তি বাস্তবায়নে অনীহা প্রকাশ করে। শেশমেষ চুক্তিটি বাতিল করে বাংলাদেশ রেলওয়েতে চিঠি দিয়েছে কোরিয়ান কোম্পানিটি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য হওয়া সাপেক্ষে দরদাতা প্রতিষ্ঠান তাদের দরপত্র দাখিল করেছিল। ঋণের প্রস্তাবটি সহজ শর্তে নমনীয় করতে পারেনি অর্থ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। সহজ শর্তে নমনীয় ঋণ দিতে ব্যর্থ হয় হুন্দাই রোটেম। একই সঙ্গে চুক্তি বাতিল ও ব্যাংক গ্যারান্টি ফেরত নেওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়।
দক্ষিণ কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানটির পারফরম্যান্স সিকিউরিটি বাবদ দুই কোটি ৩৯ লাখ ৪৫ হাজার ৬৮৬ মার্কিন ডলার ব্যাংক গ্যারান্টি বাংলাদেশ রেলওয়েতে জমা আছে। তবে ২৬ লাখ মার্কিন ডলার সমমূল্যের সিকিউরিটি আগেই ফেরত নিয়েছে তারা।
রেলপথ মন্ত্রণালয় জানায়, এ প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়াটি জটিল ও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এক্ষেত্রে অডিট আপত্তি হতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির আবেদন অনুযায়ী চুক্তি বাতিল ও পারফরম্যান্স ব্যাংক গ্যারান্টি ফেরত দেওয়ার বিষয়ে সিপিটিইউর (সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট) ও আইএমইডির (বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ) মূল্যায়ন প্রতিবেদন নেবে সরকার। পরবর্তীসময়ে অন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।