একসময় বরেন্দ্রভূমিতে মানুষের জনজীবনের সঙ্গে অতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে ছিল মৃৎশিল্প। বাঙালির নানা উৎসব ও পূজা-পার্বণে ব্যবহার হতো মাটির তৈরি তৈজসপত্র। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার আগ্রাসন এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রতি সরকারি পৃষ্টোপোষকতা কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগ না থাকায় আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প।

রাজশাহীর ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, একসময় রাজশাহী শহরে কুমারপাড়ায় তৈরি হতো মাটির জিনিসপত্র। কিন্তু কালের পরিক্রমায় মাটির তৈরি আসবাবপত্রের চাহিদা লোপ পাওয়ায় নগরীর কুমারেরা ছেড়েছেন তাদের পূর্ব-পুরুষের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের পেশা। এখন নগরীতে একটি ঘরেও হয় না মৃৎশিল্পের কাজ। মাটির এ শিল্পটি যেন মাটিতেই মিশে গেছে।

অথচ দুই যুগ আগেও নগরীর জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু করে আলুপট্টির মোড় ও সাগরপাড়া শিবতলা পর্যন্ত বসতো জমজমাট মেলা। পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, উল্টো ও সিধে রথে মেলার আয়োজন হতো। সেসময় শুধু রাজশাহীই নয়, আশপাশের জেলা থেকেও ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য নিয়ে ভিড় জমাতেন।

বর্তমানে রাজশাহী নগরীতে বছরে একবার বসে রথের মেলা। এ মেলায় মৃৎশিল্পের কদর না থাকায় আসেন না মৃৎশিল্পের কারিগরেরা। যার কারণে মৃৎশিল্পের জায়গাটি এখন দখল করেছে কাঁচ, প্লাস্টিক ও বিভিন্ন ধাতব পণ্য। আর এসব কারণে আগের মতো মেলার জৌলুস বা চাকচিক্যও খুব একটা চোখে পড়ে না। তবে গ্রামাঞ্চলে মেলার আয়োজন হলে কিছু দৃষ্টিগোচর হয় মৃৎশিল্পের তৈজসপত্র।

তারপরও কিছু কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের চাহিদা নগর ও গ্রামজুড়ে থাকার কারণে আজও কোনো রকম টিকে রয়েছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ ক্ষুদ্র শিল্পটি। রাজশাহীর হাতে গোনা দু-চারটি উপজেলায় ঐতিহ্যবাহী শিল্পটিকে পেশা হিসেবে ধরে রেখেছে কিছু কুমার পরিবার। তাদের বদৌলতে টিকে আছে মৃতপ্রায় এ শিল্পটি।

ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পটি এখনো আকড়ে ধরে আছে গোদাগাড়ীর প্রেমতলী কুমারপাড়া এলাকার ২৩টি কুমার পরিবার। বর্তমানে এ গ্রামে ২৫টি কুমার পরিবারের বসবাস হলেও ২টি পরিবার ছেড়েছে এ পেশা। গ্রামটিতে ঢুকতেই রাস্তার পাশে সারি সারি কাঁচা, আধা-কাঁচা মাটির তৈরি পাত্র রোদে শুকাতে দেখা যায়। এছাড়াও রাস্তার একপাশে পাঁচ থেকে সাতটি দোকানে দেখা যায় মাটির তৈরি নানান তৈজসপত্রের সমাহার।

নিত্য ব্যবহার্য হাড়ি-পাতিল, ঘটি-বাটি, শানকি, কলসি, পোড়া মাটির পুতুল, মাটির মূর্তি, অলংকৃত পোড়ামাটির ফলক, মাটির প্রদীপ, ফুলদানি, খোলা, কড়াই, কয়েলদানি, এস্ট্রে, মগ, কলস, ব্যাংক, দৈ এর পাত্র ইত্যাদি সব তৈজসপত্র। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় রুটি বানানো খোলা, কড়াই ও দৈ রাখার পাত্র। শীতকালে ফুলদানি ও ফুলের টব বিক্রি হয় ভালো। এছাড়া একেক সময় একেক ধরনের জিনিস বিক্রি হয়।

তবে দুই যুগ আগেও এ শিল্পতে যে প্রাণ ছিল তা আজ নেই বললেই চলে। এনিয়ে নানান সমস্যার কথা তারা তুলে ধরেন  কাছে।

কাঠের গোল চাকতির ওপর মাটি রেখে তা ঘুরিয়ে সুনিপূণ হাতে ফুলের টব তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন প্রেমতলী কুমারপাড়ার মৃৎশিল্পী বিনয় কুমার পাল। তিনি জানান, মৃৎশিল্পের জন্য পর্যাপ্ত মাটি আহরণ ও সংরক্ষণের সমস্যা, বাড়তি খরচ, উন্নত প্রশিক্ষণ, উন্নত যন্ত্রপাতির অভাব ও প্লাস্টিক-সিরামিকসহ ধাতব দ্বারা তৈরি আসবাবপত্রের দৌরাত্মের কথা।

এমন সঙ্কট নিরসনে তার দাবি উন্নত কলাকৌশলের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে ক্ষুদ্র ঋণ ও উন্নত যন্ত্রপাতির। আধুনিক কলাকৌশলসহ উন্নত হিট মেশিন ও নকশা করার যন্ত্রপাতি পেলে দ্রুত সময়ের মধ্যেই অনেক উন্নতমানের সিরামিক্সের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় মাটির পণ্য তৈরি সম্ভব। এতে আবারো মৃৎশিল্পের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাওয়ার সম্ভবনাও রয়েছে বলেও দাবি মৃৎশিল্পী বিনয়ের।

ওই গ্রামেই কথা হয় আরেক মৃৎশিল্পী গোপাল চন্দ্র পালের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের মাটি আনার যেমন সমস্যা, তেমনি মাটি রাখারও রয়েছে সমস্যা। মাটি কাটাতে একজন পাইট বা শ্রমিককে দিতে হয় ৫০০ টাকা। তার ওপর আছে পরিবহন খরচ। আবার মাটি আনার পর তা সংরক্ষণ করতে পারি না। অন্যের মাটিতে রাখলে অনেকেই নানান কথা শোনায়। আবার আমরা এখনো সেই আগের যুগের মতোই জিনিসপত্র বানাই। আধুনিক কলাকৌশল ও যন্ত্রপাতি পেলে আমরাও ভালো কিছু করতে পারতাম।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মেলাতে হলে দেশের ঐতিহ্যবাহী ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পগুলো বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। প্রয়োজন ওই সমস্ত শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের সরকারি সহযোগিতার। যেমনটি করছে ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, নেপালসহ অন্যান্য দেশগুলো। তারা তাদের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উন্নত কলাকৌশল এবং প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের স্বীয় ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছে। এমনকি তাদের ঐতিহ্যবাহী ক্ষুদ্রশিল্পের পণ্যগুলোকে আরও আকর্ষণীয় করে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে, অথচ আমরা তাতে পুরোপুরি ব্যর্থ।

ঐতিহ্যবাহী শিল্পটিকে টেকানোর বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যকে টেকাতে হলে মৃৎশিল্পীদের আধুনিক যন্ত্রপাতি ও কলাকৌশলের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের সহযোগিতায় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদেরও মৃৎশিল্প ব্যবহারের মানসিকতা তৈরি করতে হবে। তবেই রাজশাহীতে উন্নতমানের মাটির তৈজসপত্র তৈরি সম্ভব।

মৃৎশিল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী বিসিকের জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) জাফর বায়েজীদ বলেন, মৃৎশিল্প নিয়ে আলাদা কোনো কার্যক্রম নেই। মৃৎশিল্পের বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো প্রকারের তথ্যও নেই।