চারপাশের গাছগাছালি, বনে-বাদাড়ে, নদী-খালে, হাওড়-বিলে চোখ রাখলে বিভিন্ন পাখি দেখা যায়। তবে সব পাখি সব স্থানে দেখা যায় না। কারণ নির্দিষ্ট কিছু পাখির বসত ও খাবার নির্দিষ্ট স্থানে। তাই নির্দিষ্ট স্থানে গিয়েই নির্দিষ্ট পাখি দেখতে হয়। এ পাখি দেখা অনেকের কাছে কোনো বিষয় নয়। আবার অনেকের কাছে খুবই গুরুত্বের। বলতে গেলে কারও কারও কাছে পাখি দেখা এক ধরনের নেশা। তাই তারা পাখি দেখার নেশায় বারো মাস ঘুরে বেড়ান সারা দেশে।

আবাসিক ও পরিযায়ী মিলে বাংলাদেশে পাখির সংখ্যা প্রায় ৭১৭ প্রজাতি। এর মধ্যে ৩০০ প্রজাতি আবাসিক। বাকি ৪১৭ প্রজাতি পরিযায়ী। বারো মাস এ দেশে থাকে বলে তারা আবাসিক পাখি। আর যারা বছরের কিছু সময় অন্য দেশে কাটায় তারা পরিযায়ী পাখি। কেউ কেউ ভুল করে পরিযায়ী পাখিদের অতিথি বলে ডাকে। এরা মোটেই অতিথি নয়। এরা এ দেশেরই পাখি। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদেই পরিযায়ী পাখিদের প্রায় আশি শতাংশ গ্রীষ্ম মৌসুমে হিমালয়ের কাছাকাছি অঞ্চলের দেশ ও বিশ শতাংশ সুদূর সাইবেরিয়াসহ মধ্য ও উত্তর এশিয়ায় চলে যায়। আবার শীতের সময় বাংলাদেশে ফিরে আসে।

সব পরিযায়ী শীতের সময় আসে না। দুই-তিনটি পাখি আছে-যারা বছরের বিভিন্ন সময় বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরতে ঘুরতে এ দেশে আসে অল্প সময়ের জন্য। তাদের বলা হয় পান্থ পরিযায়ী। আর যে পাখি বেশি দেখা যায় তাদের সুলভ, আর যে পাখি কম দেখা যায় বা দেখা যায় না তাদের নামের আগে দুর্লভ, বিরল, বিপন্ন বা মহাবিপন্ন শব্দ বসানো হয়। অবশ্য পরিবেশগত কারণে এরই মধ্যে ৩০-৩২টি পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে এ দেশ থেকে। আবার অনেক নতুন নতুন পাখি দেখার তথ্যও যোগ হচ্ছে।

পরিযায়ী পাখিদের অধিকাংশ এদেশে দেখা যায় শীত মৌসুমে এবং তার অধিকাংশ জলচর। তাই এদের বিচরণ ভোলা, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরগুনা, রাজশাহী, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, মহেশখালী, সুন্দরবন ও হাওড়াঞ্চলের চর, বিল বা জলাভূমিতে। শীত মৌসুমে উপকূলের চর বা বিলে যেসব জলচর পরিযায়ী পাখি বেশি দেখা যায় তার মধ্যে আছে-দেশি কানিবক, গো বগা, মাঝলা বগা, ধুপনি বক, কালামাথা কাস্তেচরা, পাতি চকাচকি, খয়রা চকাচকি, ইউরেশিও সিঁথিহাঁস, পাতি তিলিহাঁস, পাতি শরালি, উত্তুরে লেঞ্জাহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, পাকড়া উল্টোঠুটি, ছোট নথজিরিয়া, কালালেজ জৌরালি, নাটা গুলিন্দা, ইউরেশিও গুলিন্দা, ছোট পানচিল, ছোট পানকৌড়ি, জুলফি পানচিল, ছোট বগা, বড় বগা, পিয়ং হাঁস, গিরিয়া হাঁস, প্রশান্ত সোনাজিরিয়া, মেটে জিরিয়া, পাতি লালপা, পাতি সবুজপা, পাতি বাটান, টেরেক বাটান, জুলফি পানচিল, খয়রামাথা গাঙচিল, কাসপিয়ান পানচিল, চামচঠুঁটো বাটান, খুন্তেবকসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।

উপকূলের চরের মধ্যে আছে হাতিয়ার দমার চর, নিঝুমদ্বীপ, জাহাজমারার চর, মোক্তারিয়ার চর, গাজীপুরা চর, মদনপুরা চর, মধুপুরা চর, দাশের হাটের চর, মনপুরার চর, তুলাতুলী চর, মাঝের চর, বালুর চর, বগার চর, হাজীপুর চর, রগকাটার চর, লতার চর, যাদবপুর চর, উড়ির চর, শাহজালাল চর, আমানত চর, ঢালচর, ঠেংগার চর, কালাকাইচ্ছা চর, পিয়াল চর, পাতাইলা চর, ছোট বাংলার চর, চর মোন্তাজ, কালাম চর, খাজুর গাইচ্ছা চর, সামছু মোল্লার চর, বোয়ালখালীর চর, বড় রানীর চর, ছোট রানীর চর, টেগরার চরসহ আরও অনেক নতুন নতুন জেগে ওঠা নাম না জানা ছোট-বড় চর।

সব চরে আবার সব জলচর পরিযায়ী পাখি বিচরণ করে না। এটি পাখিদের অলিখিত একটি নিয়ম।

একেক প্রজাতির পাখি একেক চরে বিচরণ করতে পছন্দ করে। জলচর হলেও এর মধ্যে আবার কিছু পাখিকে সৈকত পাখি বলা হয়। কারণ তারা সৈকতের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। এ ছাড়া এসব চরের মধ্যে কিছু বিশেষ চরও রয়েছে। যে চরগুলোতে বিশেষ কিছু পাখির বিচরণও রয়েছে। যেমন- নোয়াখালীর হাতিয়ার দমার চরে বিশ্বের মহাবিপন্ন চামচঠুঁটো বাটান পাখি দেখা যায় মাঝেমধ্যে দুই-একটি। এ ছাড়া দুর্লভ কালামাথা কাস্তেচরা পাখির অন্যতম বিচরণ ভূমিও এ চর। বিরল ইউরেশীয় চামচঠুঁটো পাখিও দেখা যায় এখানে। এ ছাড়া এ চরে একইসঙ্গে অনেক প্রজাতির হাজারো পাখি দেখা যায়। যার মধ্যে অনেক দুর্লভ, বিরল, বিপন্ন প্রজাতির পাখিও আছে। এ ছাড়া হাতিয়ার জাহাজমারা মোক্তারিয়া চ্যানেলে ও এর আশপাশেই ঝাঁকেঝাঁকে দেখা যায় বিপন্ন দেশি গাঙচষা পাখি।

উপকূলে জলচর পাখিদের বড় একটি বিচরণভূমির ভোলার চর ফ্যাশন থানার মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে ওঠা চর শাহজালাল। এ চরের বয়স প্রায় বিশ বছর। শীত মৌসুমে এ চরে একসঙ্গে প্রায় পঞ্চাশ প্রজাতির হাজারো পাখি দেখা যায়।

বিশ্বব্যাপী পাখি নিয়ে গবেষণা করছে ওয়েটল্যান্ডস ইন্টারন্যাশনাল (ডব্লিউআই) সংস্থা। এ সংস্থার এশিয়া অঞ্চলের সংগঠনের নাম-এশিয়ান ওয়াটার বার্ড সেনসাস (এডব্লিউসি)। এ সংস্থা প্রতি বছর শীতকালে এশিয়ার দেশগুলোতে একযোগে জলচর পাখি শুমারি করে থাকে।

উপকূল ছাড়াও জলচর পরিযায়ী পাখিদের আরেকটি বৃহৎ বিচরণভূমি সিলেটের হাওড়াঞ্চল। বিশেষ করে মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের হাকালুকি হাওড়, হাইল হাওড়, বাইক্কাবিল, টাঙ্গুয়ার হাওড়সহ এর আশপাশের বিভিন্ন হাওড়গুলো শীতের সময় পরিযায়ী পাখিদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়।

শীতের সময় এসব হাওড়ে যেসব পরিযায়ী পাখি বিচরণ করে, তার মধ্যে আছে ছোট ডুবুরি, বড় খোঁপাডুবুরি, বড় পনকৌড়ি, ছোট পনকৌড়ি, উদয়ী গয়ার, দেশি কানিবক, ধুপনি বক, লালচে বক, বড় বগা, ছোট বগা, মাঝলা বগা, গো বগা, এশীয় শামখোল, কালামাথা কাস্তেচরা, পাতি শরালি, মেটে রাজহাঁস, খয়রা চকাচকি, পাতি চকাচকি, তিলিহাঁস, পিয়াং হাঁস, সিঁথিহাঁস, ফুলুরি হাঁস, পাতি তিলিহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস, গিরিয়া হাঁস, পাতি ভুতিহাঁস, বেয়ারের ভুতিহাঁস, টিকি হাঁস, মরচেরঙ ভুতিহাঁস, কোড়া, ধলাবুক ডাহুক, পাতি মানমুরগি, বেগুনি কালেম, পাতি কুট, নেউ পিপি, দল পিপি, কালাপাখ ঠেঙ্গি, মেটেমাথা টিটি, হট টিটি, উত্তুরে টিটি, প্রশান্ত সোনাজিরিয়া, ছোট নথজিরিয়া, কেন্টিশ জিরিয়া, ছোট ধুলজিরিয়া, ছোট বাবুবাটান, পাতি চ্যাগা, ল্যাঞ্জা চ্যাগা, কালালেজ জৌরালি, তিলা লালপা, পাতি লালপা, পাতি সবুজ পা, বিল বাটান, বন বাটান, পাতি বাটান, লাল নুড়িবাটান, গুলিন্দা বাটান, ছোট চাপাখি, টেমিকেংর চাপাখি, খয়রামাথা গাঙচিল, কালামাথা গাঙচিলসহ বিভিন্ন পাখি।

হাকালুকি হাওড়, হাইল হাওড়, টাঙ্গুয়ার হাওড়, বাইক্কাবিলসহ এর আশপাশে যে হাওড় রয়েছে তার মধ্যে ছোট-বড় অনেক বিল আছে। হাকালুকি হাওড়ের বিলগুলোর মধ্যে আছে জলা বিল, বালুজুড়ি, মাইসলা, কুকুরডুবি, ফুয়ালা, পোলাভাঙ্গা, হাওড়খাল, কোয়ার কোণা, মালাম বিল, গোয়ালজুড়, চাড়ুয়া, তেকোনা, ভাইয়া, গজুয়া, রঞ্চি, হারাম, বিড়াল খালসহ বিভিন্ন বিল। এসব হাওড়েও পাখিশুমারি করা হয় প্রতি বছর। উপকূল ও হাওড় অঞ্চল ছাড়াও সুন্দরবনে প্রায় ৩১৫ প্রজাতির পাখির বসবাস রয়েছে। এর মধ্যে ৮৪ প্রজাতি পরিযায়ী।