হলুদচাষি সাজিদুল হক। বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙামাটিয়া ইউনিয়নের পাহাড় অনন্তপুর গ্রামে। প্রতি বছর তিনি ৬০ শতাংশ জমিতে হলুদ চাষ করেন। কিন্তু এবার তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৫ শতাংশে। বাকি জমিতে কমলা ও লেবুজাতীয় ফল চাষ করেছেন। মূলত হলুদ চাষে লাভের চেয়ে খরচ বেশি হওয়ায় কমলা ও লেবুজাতীয় ফল চাষে ঝুঁকেছেন তিনি। বর্তমানে ফুলবাড়িয়ার প্রায় ১০ হেক্টর জমি শুধু মাল্টাচাষের আওতায় এসেছে। এসব জমিতে আগে হলুদচাষ হতো বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া, মুক্তাগাছা ও ভালুকা উপজেলার পাহাড়ি লাল মাটিতে হলুদের আবাদ বেশি হয়। তার মধ্যে ফুলবাড়িয়ার পাহাড়ি মাটিতে উৎপাদিত হলুদের সুনাম সারাদেশে। তবে পাহাড়ি মাটিতে আবাদ হওয়া হলুদের দাম কম থাকায় চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষকরা। গত কয়েক বছর ধরেই হলুদের দরপতন নিয়ে অনেক হলুদ ব্যবসায়ী লোকসানের মুখে পড়েছেন। একসময় উপজেলার উপজেলার বাকতা, কালাদহ, নাওগাঁও, রাঙামাটিয়া ও এনায়েতপুর ইউনিয়নে ব্যাপকভাবে হলুদের আবাদ হতো। কিন্তু এখন এসব এলাকায় চাষ বেড়েছে কমলা ও লেবুজাতীয় ফলের।

কথা হয় রাঙামাটিয়া ইউনিয়নের হলুদচাষি শরিফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, ৬০ শতাংশ জমিতে তিনি হলুদের আবাদ করেছেন। তার খরচ হয়েছে ৩২ হাজার টাকা। হলুদক্ষেত পাইকারদের কাছে বিক্রি করতে গেলে বর্তমান বাজার দরে ২২ হাজার টাকা দাম করেছেন তারা। পাইকারদের কাছে লোকসান দিয়ে ক্ষেত বিক্রি না করে তিনি নয় হাজার টাকা খরচ করে শ্রমিক দিয়ে হলুদ উঠিয়ে বাড়িতে রেখেছেন।

ফুলবাড়িয়ার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আসাদুর রহমান  বলেন, ফুলবাড়িয়ার হলুদ ঐতিহ্যবাহী। এখানকার হলুদের সারা বাংলাদেশে সুনাম রয়েছে। এই হলুদ বছরে একবারই চাষ করা হয়। ফুলবাড়িয়ার পাহাড় অনন্তপুর গ্রামে লেবু চাষ বাড়ছে। লেবুতে ভালো মুনাফা পাওয়ায় চাষিরা সেদিকে ঝুঁকছেন। এজন্য হলুদের জমি দখল হয়ে যাচ্ছে লেবু-মাল্টা চাষে। কাজেই হলুদ চাষ কমে যাচ্ছে।

ফুলবাড়ীয়ার পাহাড়ি লাল মাটিতে উৎপাদিত হলুদের সুনাম রয়েছে সারাদেশে

‘হলুদের দাম দুইভাবে হয়। শুকনা ও কাঁচা হলুদ। কাঁচা হলুদের দাম কম। হলুদ বাড়িতে রেখে শুকনা অবস্থায় বিক্রি করলে ভালো দাম পাওয়া যায়। কিন্তু কৃষক সরাসরি জমি থেকে হলুদ বিক্রি করছেন। ব্যবসায়ী মাঠ থেকে হলুদ কিনে স্টক করে রাখে। হলুদ সংগ্রহের সময় দাম কম হয় তখনই কৃষক হলুদ বিক্রি করে দেয়। যার কারণে হলুদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন কৃষক।’

হলুদ চাষ কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ও মন্দা দেখা দিয়েছে। খরচ বাদ দিলে লাভের বদলে লোকসানই বেশি হচ্ছে। যেসব চাষি হলুদের জমিতে শ্রম দেন তারাই কিছুটা লাভবান হন। বাকি চাষিরা লাভের বদলে লোকসানে পড়েন বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। এছাড়া দেশে ভারত ও মিয়ানমারের হলুদের আমদানি বাড়ছে। এসব কারণেই মূলত হলুদ চাষে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন চাষিরা।

যেসব চাষি জমিতে নিজে শ্রম দেন তারাই কিছুটা লাভবান হন, বাকিরা লোকসানে পড়েন বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের

ফুলবাড়িয়া উপজেলার হলুদ ব্যবসায়ী আবদুস সালাম আকন্দ রুবেল বলেন, কয়েক বছর ধরে হলুদের দামের কোনো ঠিক নেই। ভারত-মিয়ানমার থেকে দেশে হলুদের আমদানি বেড়েছে। ফলে দেশি হলুদের দাম কমে যায়। গত বছর হলুদের ব্যবসা করে আমার দুই লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। গত মৌসুমে মণপ্রতি সাত-আটশো টাকা দরে এক হাজার মণ কাঁচা হলুদ কিনেছিলাম। কিন্তু হলুদ শুকানোর পর আশানুরূপ দাম পাইনি।

তিনি আরও বলেন, এবার পাঁচ-ছয়শো টাকা মণ দরে কাঁচা হলুদ কিনেছি। ফুলবাড়িয়ায় স্থানীয় জাতের হলুদের আবাদ বেশি হয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী মধুপুরের কৃষকরা মালা নামের এক ধরনের হলুদ চাষ করেন। ওই হলুদের ফলনও বেশি। বর্তমানে শুকনা হলুদ তিন হাজার ২শ টাকা থেকে শুরু করে চার হাজার ৫শ টাকা মণ হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। তবে দেশি হলুদের দাম কম। এক কাঠা (সাড়ে ৬ শতাংশ) হলুদ চাষে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু কৃষক বিক্রি করে টাকা পাচ্ছেন মাত্র চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। কৃষকের অনেক ঘাটতি হচ্ছে, ফলে কৃষক হলুদচাষ ছেড়ে দিচ্ছে। হলুদের চাষও কমে যাচ্ছে। হলুদ বাদ দিয়ে পাহাড়ি কলা, লেবু, আনারস চাষ করছেন চাষিরা।

হলুদের চাষ কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ও দেখা দিয়েছে মন্দাভাব

ফুলবাড়িয়ায় সব ধরনের মাটিতে হলুদ চাষ করা যায়। দোআঁশ ও বেলে-দোআঁশ মাটি হলুদচাষের জন্য অতি উত্তম। চৈত্র মাস কন্দ লাগানোর উপযুক্ত সময়। ১৫ থেকে ২০ গ্রাম ওজনের এক থেকে দুই ঝুড়িবিশিষ্ট কন্দ লাগাতে হয়। ৫০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে সারি করে ২৫ সেন্টিমিটার দূরে দূরে ৫ থেকে ৭ সেন্টিমিটার গভীরে কন্দ লাগাতে হয়। প্রতি হেক্টরে ২ হাজার ৫শ কেজি কন্দ প্রয়োজন হয়। কন্দ লাগানোর পর ভেলি (জমি আলগা করে দেওয়া) করে দিতে হয়। ডিমলা ও সিন্দুরী নামে বাংলাদেশে দুটি উন্নত জাত রয়েছে। ডিমলা জাতটি স্থানীয় জাতের তুলনায় তিনগুণ বেশি ফলন দেয়।

প্রতি হেক্টরে সার দিতে হয় গোবর ৪-৬ টন, ইউরিয়া ২০০-২৪০ কেজি, টিএসপি ১৭০-১৯০ কেজি, এমওপি ১৬০-১৮০ কেজি, জিপসাম ১০৫-১২০ কেজি ও জিংক সালফেট ২-৩ কেজি। জমি তৈরির সময় সমুদয় গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিংক সালফেট ও ৮০ কেজি এমওপি সার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হয়।

দেশে ভারত ও মিয়ানমারের হলুদের আমদানি বাড়ায় দেশি হলুদের কদর কমছে

কন্দ লাগানোর ৫০ থেকে ৬০ দিন পর ১০০ থেকে ১২০ কেজি ইউরিয়া দিতে হয়। সাধারণত হলুদ লাগানোর ৯ থেকে ১০ মাস পর পাতা শুকিয়ে গেলে হলুদ সংগ্রহ করা হয়। প্রতি হেক্টরে ২৫ থেকে ৩০ টন কাঁচা হলুদ পাওয়া যায়। জমি তৈরির সময় অর্ধেক ইউরিয়া, সমুদয় গোবর, টিএসপি, এমপি, জিপসাম ও জিংক অক্সাইড সার প্রয়োগ করা হয়। এছাড়া হলুদের জমিতে নিয়মিত নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হয়।

ময়মনসিংহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, দেশের লেবুজাতীয় ফলের (মাল্টা, লেবু, কমলা, বাতাবি লেবু) অধিকাংশ চাহিদা মেটাতে সরকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। লেবুজাতীয় ফসল উৎপাদনে নতুন একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নতুন করে আরও ৪০ হাজার টন মাল্টা ও লেবুজাতীয় ফল উৎপাদিত হবে। এতে সরকারের আমদানি কমে সাশ্রয় হবে প্রায় ৪শ কোটি টাকা। লেবুজাতীয় ফসল চাষের জন্য কৃষকদের নানা ধরনের সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। মূলত এসব কারণেই লেবুজাতীয় ফসলের চাষ বেড়েছে। তবে কমলা ও লেবুর জোয়ারে যেন হলুদ হারিয়ে না যায় সেজন্য উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে।

হলুদচাষে লাভের চেয়ে খরচ বেশি হওয়ায় হলুদচাষ ছেড়ে কমলা ও লেবুজাতীয় ফল চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা

ময়মনসিংহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মতিউজ্জামান বলেন, ফুলবাড়িয়া এলাকায় হলুদ চাষ কমছে। অনেক বাগানে কমলা ও লেবুজাতীয় ফল চাষ হচ্ছে। আমাদের প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন বাগান করায় কৃষককে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে ফলে কৃষক লাভবান হচ্ছেন। মাল্টার দামও ভালো।

ময়মনসিংহে হলুদচাষের ঐতিহ্য ধরে রাখা হবে বলে জানিয়ে এই উপ-পরিচালক বলেন, ফুলবাড়িয়া, ত্রিশাল ও ভালুকায় হলুদ চাষ ধরে রাখতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা হলুদ চাষের নানা প্রদর্শনী করছি। পাশাপাশি চাষিদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। হলুদ চাষ ধরে রাখতে প্রয়োজনে চাষিদের আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হবে।