আমদানি-রপ্তানি সম্প্রসারণে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) ও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। তালিকায় আছে যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, বাহরাইনসহ ইসলামিক দেশগুলো। তবে বিশেষ গুরুত্বে আছে যুক্তরাজ্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এফটিএ-পিটিএর বাইরে গিয়ে কিছু করা যায় কি না তা নিয়েও চলছে জোর প্রচেষ্টা। যুক্তরাজ্যের বাজারে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ব্যাপক। শুধু সুযোগ তৈরি করে সেটা কাজে লাগাতে হবে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণই সরকারের প্রধান লক্ষ্য।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, জাতিসংঘের মানদণ্ড অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য তিনটি সূচকে এরই মধ্যে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। সে হিসেবে ২০২৪ সালের মধ্যেই স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করার সময়সীমা ছিল। বাংলাদেশের অনুরোধে তা ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের সময় দেশগুলোর সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দেখা দেয় বাণিজ্যিক সুবিধা হারানো। তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হন রপ্তানিকারকরা। বাধাগ্রস্ত হয় রপ্তানি। শুল্ক বাধাও জোরালো হয়ে ওঠে।
উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের পথে শুল্ক সুবিধাবঞ্চিত হলে বাংলাদেশকেও মাশুল হিসেবে ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বাড়তি খরচ করতে হবে। ২০২৬ সালের পর থেকে আরও নয় বছরের শুল্কমুক্ত সুবিধা চাইবে বাংলাদেশ। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের রপ্তানি-আমদানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা অব্যাহত রাখতে পারে এফটিএ। এ লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যসহ নানা দেশের সঙ্গে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যচুক্তি চায় বাংলাদেশ।
এফটিএ-পিটিএ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, আমরা ইসলামিক দেশের সঙ্গে এফটিএ-পিটিএ করতে চাই। এ বিষয়ে নানা ধরনের আলোচনা করছি। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যচুক্তি করতে চাই।
যুক্তরাজ্যের সঙ্গে এফটিএ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে এফটিএ-পিটিএর সমন্বয়ে নতুন কিছু ভাবছি। আলাদা কোনো পণ্য নিয়ে চুক্তি করা যায় কি না চিন্তা-ভাবনা করছি। এফটিএ-পিটিএর বাইরে গিয়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে নতুন কিছু করা যায় কি না সেটাও ভাবছি। মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যেই এসব চিন্তা করা হচ্ছে।
২০২১ সালে ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে একক দেশ হিসেবে আলাদা হয়ে গেছে যুক্তরাজ্য। আর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। শুল্কসুবিধা নিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানির বড় বাজার ইউরোপে। পরিসংখ্যান বলছে, এ সুবিধা ২০২৬ সালের পর আরও তিন বছর পাবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের উন্নয়নে নতুন প্রজন্মের ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তিনি বলেন, বেসরকারিখাতের অবদানে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ব্রিটেনে যেভাবে বাংলাদেশিরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে দেশেও মেধাশক্তি কাজে লাগাতে পারলে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
যুক্তরাজ্যে সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১০ লাখের বেশি বাংলাদেশি। যুক্তরাজ্যের তিন লাখ ১২ হাজার কোটি ডলারের বিশাল অর্থনীতিতে বাংলাদেশিদের অবদানও কম নয়। মেধা ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন খাতে কাজ করছে বাংলাদেশিরা। মেধা ও দক্ষতা বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছে কো-ফেডারেশন অব ব্রিটিশ ইন্ডাস্ট্রি।
যুক্তরাজ্যের বাজারে প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এর বেশিরভাগই তৈরি পোশাক। তবে কৃষিজাতসহ অন্য পণ্য বাজারজাত করতেও ব্যবসায়ীরা কাজ করছেন।
যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে বছরে ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন পাউন্ড অবদান রাখে বাংলাদেশিদের শ্রমে গড়া ১২ হাজার রেস্তোরাঁ। তিন লাখ ১২ হাজার কোটি ডলারের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাজ্য। লন্ডনের পর শিল্প-বাণিজ্যের শহর ম্যানচেস্টারের প্রবাসী বাংলাদেশি ও স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী বাংলাদেশে বিনিয়োগে।
কনফেডারেশন অব ব্রিটিশ ইন্ডাস্ট্রির (সিবিআই) উদ্যোগে যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্যচুক্তির প্রস্তাবটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। এটাকে ইতিবাচক মনে করছেন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। সিবিআই মূলত ১৯ হাজারের বেশি ব্রিটিশ ব্যবসায়ীর একটি শক্তিশালী লবিং গ্রুপ। সিবিআইএর মতে, বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের দেশ। প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। পাশাপাশি মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ বাস্তবায়ন হচ্ছে মেগা প্রকল্প। এসব কারণে যুক্তরাজ্যের ব্যবসায়ীরা এখন বাংলাদেশের বাজারকে গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। ব্রেক্সিট-পরবর্তী যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক বাণিজ্যনীতি এফটিএতে ফোকাস করেছে। এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এমনকি ভারতের সঙ্গেও এ সংক্রান্ত চুক্তি হয়েছে।
সিবিআই প্রধান লর্ড কারান ফারিদুন বিলিমোরিয়া বলেন, সিবিআই আশা করছে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশও এফটিএ চুক্তি সই করতে আগ্রহী হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বাড়ছে এবং সেখানে মাথাপিছু আয়ও বাড়ছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশ এফটিএ প্রস্তাবকে বেশ সম্ভাবনাময় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি ড. ওয়ালী তসর উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ এখানে শুল্কমুক্ত বাজার উপভোগ করলেও যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশ এফটিএ উভয় দেশের জন্য একটি বিজয়ী চুক্তি হতে পারে।
ব্রিটিশ বাংলাদেশি ইম্পোটার্স অ্যাসোসিয়েশন নেতা ও ব্রিটিশ-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক রফিক হায়দারবলেন, বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্যের মধ্যে দ্রুত মুক্ত বাণিজ্যচুক্তির (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু চুক্তি করলে হবে না, নিতে হবে এর সুফল। যুক্তরাজ্যে দ্রুত সময়ে পণ্য রপ্তানির পাশাপাশি মানসম্মত পণ্য রপ্তানিতে আরও জোর দিতে হবে। যুক্তরাজ্য শতভাগ আমদানিনির্ভর একটি দেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাজ্য পণ্য আমদানি করে। এফটিএ চুক্তির মাধ্যমে এখানে বড় অংকের পণ্য রপ্তানি করতে পারে বাংলাদেশ।
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাজ্য বড় বাজার। এর পরিমাণ এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। অথচ বাংলাদেশ এখান থেকে সুবিধা নেওয়ার ধারে কাছেও নেই। তাই দ্রুত বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্যের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি হতে হবে। শুধু এফটিএ করে বসে থাকলে হবে না, মানসম্মত পণ্য রপ্তানির পাশাপাশি দ্রুত পণ্য রপ্তানির সব সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। যুক্তরাজ্য মূলত আমদানিনির্ভর একটি দেশ। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে এই বাজারে আরও বেশি করে প্রবেশ করতে পারে বাংলাদেশ।