রাজধানীর কলাবাগানের গ্রিন লাইফ হাসপাতালের চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান লিপি (৪৭) হত্যাকাণ্ডের পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও এখনো অন্ধকারে পুলিশ। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি তারা। ঘটনার পর থেকে সন্দেহভাজন, প্রত্যক্ষদর্শী, সহকর্মী ও স্বজনসহ অর্ধশতাধিক লোককে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেও মেলেনি কোনো ক্লু (সূত্র)। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তবে ছেড়ে দেওয়া হলেও তাদের নজরদারিতে রাখছেন গোয়েন্দারা। শুরুর দিকে পুলিশের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে এটি ‘হত্যাকাণ্ড’ বলা হলেও তদন্তে কিছু না পেয়ে ‘আত্মহত্যা’ হতে পারে বলেও সন্দেহ করতে থাকেন তদন্তকারীরা।
চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি কাগজে-কলমে থানা পুলিশ তদন্ত করলেও রহস্য উদ্ঘাটনে ডিবিসহ অন্য সংস্থাও ছায়াতদন্ত শুরু করে। পরবর্তীসময়ে আলোচিত এ ঘটনায় কিছু না পাওয়ায় গত ২২ আগস্ট মামলাটির তদন্তভার পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বর্তমানে মামলাটির তদন্ত করছে পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রো উত্তর বিভাগ।
তদন্তে এক মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি পিবিআই। তবে, পিবিআই’র দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, গত ২২ আগস্ট মামলাটির তদন্তভার পায় পিবিআই। তদন্তে নেমে প্রথমে কলাবাগান থানা পুলিশের কাছ থেকে সব ধরনের ডকুমেন্ট পায় সংস্থাটি। এর আগে তদন্ত করেছে ডিবি। অন্যদিকে, তদন্তের শুরুতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়া গেলেও পরে প্রতিবেদনটি পিবিআইয়ের হাতে এসেছে। আশা করা যাচ্ছে, শিগগির হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন হবে।
হত্যাকাণ্ডের শিকার ওই চিকিৎসকের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। মোবাইল ফোনের কললিস্টের সূত্র ধরে বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কললিস্ট ধরে রহস্য উদ্ঘাটন করা যায় কি না সেটি দেখছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
তদন্ত সংশ্নিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, চিকিৎসক কাজী সাবিরার বাসার সিঁড়ি থেকে শুরু করে কক্ষ পর্যন্ত বেশকিছুর আলামত সংগ্রহ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল দুটি সিগারেটের উচ্ছিষ্টাংশও। ল্যাবে ডিএনএ (ডি-অক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড) পরীক্ষায় এর একটিতে অজ্ঞাতপরিচয় এক পুরুষের ডিএনএ মিলেছে, অপরটি মাল্টিপল নমুনা (অর্থাৎ একাধিক ব্যক্তির ডিএনএর উপস্থিতি রয়েছে ওই অংশে)। এখন সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের কাছ থেকে ডিএনএ নমুনা নিয়ে হত্যাকারীকে শনাক্তে চেষ্টা করা হবে। যার জন্য চলছে তালিকা তৈরির কাজ।
তদন্ত সংশ্নিষ্ট সূত্রটি জানায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ থেকে সাবিরার মরদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনও পাওয়া গেছে। তাতে বলা হয়েছে, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের আগে ওই চিকিৎসক যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন কি না, ফরেনসিক বিভাগে তা জানতে ভ্যাজাইনাল সোয়াব পরীক্ষা করতেও পাঠিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। তবে ফরেনসিক ল্যাবের ভিসেরা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হত্যাকাণ্ডের আগে নিপীড়ন বা ধর্ষণের কোনো আলামত মেলেনি।
যেভাবে সাবিরা হত্যার ঘটনা জানতে পারে পুলিশ
কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পরিতোষ চন্দ্র পাল বলেন, ডা. সাবিরার পাশের রুমে একজন মডেল থাকতেন। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মেয়েটি এ বাসায় সাবলেটে ওঠেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জেনেছি, সেই মডেল সকাল ৬টা ১০ মিনিটের দিকে ধানমন্ডি লেকে শরীরচর্চা করতে বেরিয়ে যান। এরপর তিনি সকাল আনুমানিক ৯টা ৪০ মিনিটে বাসার প্রধান গেট খুলে ভেতরে ঢুকে ধোঁয়া ও পোড়া গন্ধ পান। তিনি তখন বাসার দারোয়ানকে জানান। এরপরে ফ্ল্যাটের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা আরেক নারীকে জানান।
পরিতোষ চন্দ্র পাল আরও বলেন, লোক জানাজানি হলে বাসার পাশের এক মিস্ত্রিকে এনে দরজার লক খুলে ভেতরে ধোঁয়াচ্ছন্ন দেখতে পান তারা। তখন বাসার আশপাশ থেকে যারা আসছিল তারা আগুন লেগেছে মনে করে পানি ছোড়েন। এরপরে তারা ফায়ার সার্ভিসকে ফোন দেন। পরে পুলিশ খবর পায়। প্রথমে বাসায় যায় কলাবাগান থানা পুলিশ। পরে তারা খবর দেয় সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটকে। এরপরে একে একে ঘটনাস্থলে আসে ডিবি, র্যাব, পিবিআইয়ের সদস্যরা।
ফায়ার সার্ভিস যা বলছে
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরের কন্ট্রোলরুমের ডিউটি অফিসার লিমা খানম বলেন, ৩১ মে সকাল ১০টা ২৫ মিনিটের দিকে ওই বাসায় আগুনের সংবাদ পাই। সেখানে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ধোঁয়া দেখতে পান। পরে সেখান থেকে একটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, মরদেহটির গলা ও পায়ের সামনের কিছু অংশ দগ্ধ ছিল। ঘরের তোশক পুড়ে গিয়েছিল। এসব দেখে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা পুলিশে খবর দিতে বলেন। পরে পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে।
পরিবার থাকতেও সাবিরা একা কেন থাকতেন?
ডা. সাবিরার এক স্বজন জানিয়েছেন, ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে নিজের কর্মস্থল গ্রিন লাইফ হাসপাতালে যাওয়ার কথা ছিল সাবিরার। সেখান থেকে কয়েকজনের সঙ্গে বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। তবে কাদের সঙ্গে কোথায় যাওয়ার কথা ছিল, তা এখনো জানা যায়নি। সাবিরা আট থেকে নয় বছর ধরে গ্রিন লাইফ হাসপাতালে চাকরি করছেন। বছর পাঁচেক আগে তার চাকরি স্থায়ী হয়। কাজ করতেন রেডিওলজি বিভাগে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় এসে কয়েকটি হাসপাতালে চাকরির পর সর্বশেষ তিনি যোগ দেন গ্রিন লাইফ হাসপাতালে।
২০০৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ডা. সাবিরার প্রথম স্বামীর মৃত্যুর হয়। এরপর ২০০৫ সালে শামসুর আজাদ নামের একজন ব্যাংকারকে বিয়ে করেন তিনি। দুই সংসারে তার দুই সন্তান রয়েছে। প্রথম সংসারের ছেলের বয়স ২১ বছর। তিনি গত কয়েক মাস ধরে কানাডা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আর দ্বিতীয় সংসারের একমাত্র মেয়ের বয়স ১০ বছর। মেয়েটি কলাবাগানের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। ছেলেটি থাকেন তার নানির সঙ্গে আর মেয়েটি থাকে তার বাবার সঙ্গে। সাবিরার মা থাকেন কলাবাগানে। বর্তমান স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় ডা. সাবিরা আলাদা থাকতেন বলে জানা যায়।
হত্যা মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামি
সাবিরার রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধারের ৩৬ ঘণ্টা পর ১ জুন দিনগত রাতে কলাবাগান থানায় মামলা করেন তার মামাতো ভাই রেজাউল হাসান মজুমদার জুয়েল। তবে মামলায় কোনো আসামির নাম উল্লেখ করা হয়নি।
কলাবাগান থানা সূত্রে জানা যায়, মামলায় দণ্ডবিধির ৩০২, ২০১ এবং ৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। অবশ্য সাবিরা খুন হয়েছেন, এমনটা ধরে নিয়েই মামলা হওয়ার আগে থেকে তদন্ত শুরু করে পুলিশ।
সাবিরার গলায় ও শরীরে একাধিক ছুরিকাঘাতের চিহ্ন
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের একটি সূত্র জানায়, সাবিরার গলায় ও শরীরে একাধিক ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে, যা দেখে মনে হয়েছে এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বেশ কিছু বিষয় সামনে রেখে হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হলেও ডা. সাবিরার পারিবারিক কিছু বিষয়ে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। এ কারণে তদন্তে বিষয়টি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে, এখনো তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে নিশ্চিত করে কিছু বলার সময় আসেনি।
ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ মামাতো ভাই রেজাউল হাসান মজুমদার জুয়েলের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে পারিবারিকভাবে তাকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
তদন্ত সংশ্নিষ্ট অপর এক কর্মকর্তা বলছেন, হত্যার ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই। ফরেনসিক ও ল্যাবের পরীক্ষার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে তাদের। তদন্তের এ পর্যায়ে তারা অনেকটা আশাবাদী হয়ে উঠলেও এখনো হত্যাকাণ্ডের কারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। একটি হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য সব কারণ মাথায় রেখেই তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। সিআইডি সাবিরার জব্দ করা মোবাইল ফোনটিরও ফরেনসিক পরীক্ষা করেছে। কিন্তু তেমন কিছু মেলেনি।
মামলার অগ্রগতি জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, মামলাটির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তদন্ত চলছে। এরইমধ্যে সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৪০ জনের বেশি মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমেও তদন্ত চলছে। সিঁড়িতে যে দু’টি সিগারেটের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে সেটির পরীক্ষা করা হয়েছে। সন্দেহভাজনদের মধ্যে ডিএনএ ম্যাচিং করে কি না সেটিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। মামলার ক্লু উদ্ঘাটনে কোনো বিষয়ই ছোট করে দেখা হচ্ছে না, সবগুলো বিষয় একসঙ্গে আমরা কাজ করছি।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তরের পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, গত ২৫ আগস্ট মামলাটির তদন্তভার পাই আমরা। এরপর ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও বিস্ফোরক প্রতিবেদন পাই। এখন এসব প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই চলছে। হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। আশা করছি, খুব শিগগিরই সাবিরা হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন হবে।