স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করতেন সেলিম এইচ রহমান। পরে নিজ উদ্যোগে ছোট পরিসরে গড়ে তোলেন হাতিল ফার্নিচার। বর্তমানে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানিও হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির পণ্য!
হাতিল ফার্নিচারের যাত্রা শুরু কীভাবে?
হাতিল ফার্নিচারের যাত্রা শুরু ১৯৮৯ সালে। তখন রাজধানীর বাড্ডায় ছোট একটি শোরুম ছিল। ওই সময় শুধু ডোর বিক্রি হতো সলিড উড অ্যান্ড ডোর’। এখনও হাতিলের লোগোতে লেখা আছে ‘ফর ডোরস অ্যান্ড ফার্নিচার’। পরে অন্য ফার্নিচার তৈরি শুরু করি। এইচএ টিম্বার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে বাবার একটি প্রতিষ্ঠান আছে।
সেখানে আমরা বিভিন্ন ধরনের কাঠ বিক্রি করতাম। পরে উৎপাদন শুরু করি। অর্থাৎ শুরু থেকেই কাঠের সঙ্গে হাতিলের সম্পৃক্ততা গভীর। এখন বিশ্বের অনেক দেশে রফতানি করছি। কানাডা, নেপাল, ভুটান, ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশে হাতিলের ফার্নিচার রফতানি হচ্ছে।
আপনাদের ফার্নিচারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য কী?
অন্যদের তুলনায় ভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরির চেষ্টা করি। মানের দিক থেকে কোনো আপস করি না। হাতিল সব সময় ‘ইনোভেটিভ আইডিয়া’ নিয়ে কাজ করে। ক্রেতার দৃষ্টিকোণ থেকে পণ্য তৈরিসহ টেকসই, দাম ও নকশায় সমন্বয়ের চেষ্টা করি। লক্ষ করলে দেখবেন, বর্তমানে বাসাবাড়ির আকার ছোট হয়ে এসেছে। ফলে বড় কিংবা ভারী আসবাব বেমানান মনে হয়। এ দিক বিবেচনায় মানানসই ও মার্জিত পণ্য তৈরিতে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা। আমরা আসলে বাহুল্যবর্জিত ফার্নিচার বিপণন করতে চাই। অধিকাংশ ফার্নিচার প্রতিষ্ঠানের পণ্যে অনেক কাঠের ব্যবহার চোখে পড়ে। এতে পণ্যের সৌন্দর্য তো বাড়েই না, উল্টো প্রচুর পরিমাণ কাঠের অপচয় হয়। ধরুন রাজধানীর মিরপুরে ১০০টি ফার্নিচার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে একেকটি প্রতিষ্ঠানে প্রডাক্ট ডিজাইনার না থাকায় অনেক বেশি উপকরণ ব্যবহৃত হচ্ছে। একজন ফার্নিচার উৎপাদক যদি মাসে পণ্য তৈরিতে ১০০ ঘনফুট কাঠ ব্যবহার করেন, তাহলে সেখানে ১০০টি প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করছে ১০ হাজার ঘনফুট কাঠ। এখানে বাহুল্য বা বালকি ডিজাইনের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো যদি গড়ে ১০ শতাংশ অতিরিক্ত কাঠ ব্যবহার করে, তাহলে ১০ হাজারের ১০ শতাংশ এক হাজার ঘনফুট অতিরিক্ত কাঠ ব্যবহার হচ্ছে ১০০ প্রতিষ্ঠান।এভাবে সারাদেশে যত ফার্নিচার প্রতিষ্ঠান আছে, সেখানে তাহলে কত কাঠের অপচয় হচ্ছে তা আসলেই একটি চিন্তার বিষয়। কাজেই এ ধারণাটি ও ডিজাইন নিয়ে কাজ করা উচিত। পাশাপাশি দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা উপযোগী পণ্য আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সমন্বয় করে ডিজাইন হওয়া উচিত। এভাবে আমাদের এই বাহুল্য কমে আসবে বলে মনে করি।
অনেক আসবাব সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নেই। বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
অনেক উপকরণ আমদানি করতে হয়। যেমন কাঠ, ফিনিশিং উপকরণ, এমডিএ, হার্ডওয়্যার প্রভৃতি। আমাদের আমদানি শুল্ক ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ। ফলে ১০০ টাকার একটি উপকরণ গিয়ে দাঁড়ায় ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায়। অর্থাৎ ১০০ টাকার পণ্য কিনতে হচ্ছে ১৬০ টাকায়। দর বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ এটি। তাছাড়া আনুষঙ্গিক আরও খরচ আছে। এছাড়া পণ্যের গুণগত মান ঠিক রাখতে হলে কিছুটা দর বাড়ে। তারপরও পণ্যের গুণগত মান অনুযায়ী অন্যদের তুলনায় আমাদের আসবাবের দাম কম। তাছাড়া দর বৃদ্ধির মানে এ নয় যে, ফার্নিচার প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক বেশি লাভ করছে। প্রকৃতপক্ষে এ খাতে সব খরচ বাদ দিয়ে ১০ শতাংশ লাভ করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।
ব্যাংক কিস্তির মাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে পণ্য কেনার সুবিধা আছে কী?
ক্রেতাসাধারণের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। হাতিলের পণ্য ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ১২ কিস্তিতে কেনার সুবিধা আছে। সিটি ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, ইবিএলসহ আরও কিছু ব্যাংকের গ্রাহক ইন্টারেস্ট ছাড়াই এ সুবিধা পান। অর্থাৎ কিস্তিতে পণ্য কেনায় কোনো সমস্যা নেই। আমরা এখনও অনলাইনভিত্তিক বিক্রি শুরু করিনি। তবে দ্রুত সে ব্যবস্থা চালু করব।
ফার্নিচার খাতকে কেন্দ্র করে কত লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে?
শুরুতে এ খাতে জনবল কম ছিল। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ফার্নিচারশিল্পের সঙ্গে প্রায় কয়েক লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে। দেশের বাইরেও কিছু লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। আমার প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বর্তমানে প্রায় দুই হাজার ৩০০ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি আরও বড় করতে যাচ্ছি। আশা করি তখন আরও কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
দক্ষ জনবল তৈরিতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা কতটা জরুরি বলে মনে করেন?
দক্ষ জনবলই একটি প্রতিষ্ঠানের মূল চালিকাশক্তি। এখানে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। যে শ্রমিক যত বেশি প্রশিক্ষণ নেন, তিনি তত বেশি দক্ষ হয়ে ওঠেন। শ্রমিক দক্ষ হলে পণ্যের মান ভালো হয় এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ে; ফলে পণ্য তৈরিতে সময় কম লাগে। এতে অল্প সময়ে অধিক পণ্য তৈরি সম্ভব হয়, যা অদক্ষ শ্রমিক দ্বারা সম্ভব নয়। এ কারণে পণ্যের দামও কম হয়। সব মিলিয়ে পণ্যের চাহিদা বাড়ে, সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের উন্নতি হয়। কাজেই প্রশিক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ।
কতদিন ধরে রফতানি করছেন। এক্ষেত্রে মূল বাধা কী?
তিন বছরের বেশি সময় ধরে আমরা পণ্য রফতানি করছি। এক্ষেত্রে উপকরণ আমদানি করে তা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রফতানি করছি। কিন্তু আমরা ফার্নিচারে শুল্ক ছাড়ের সুবিধা পাই না। অথচ আমদানি-রফতানি নীতিতে বলা হয়েছে: কেউ যখন কোনো কাঁচামাল আমদানির পর সেটি দিয়ে পণ্য তৈরি করে রফতানি করবে, তখন সেই শুল্ক ফেরত দেওয়া হব।।
পদ্ধতিও আছে; কিন্তু অনেক জটিল। অর্থাৎ শুল্ক ফেরত নেওয়ার উপায় আছে; কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে তা ফেরত নিতে পারছি না। এ কারণে দেশের কোনো ফার্নিচার প্রতিষ্ঠানই শতভাগ রফতানিমুখী নয়। লক্ষ্য করলে দেখবেন, তৈরি পোশাক খাত রফতানিনির্ভর। তাদের বন্ড সুবিধা আছে; কিন্তু আমাদের নেই।
বিষয়টি সরকারকে জানিয়েছি। আমরা চাই ১০০ টাকায় বিকল্প হিসেবে ২৫ টাকা ফেরত দেওয়া হোক। কারণ গড়ে ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ শুল্ক কাঁচামালের ওপর দিয়ে এসেছি। ২৫ শতাংশ ফেরত দিলে রফতানির পর ডলার যখন সঠিক প্রক্রিয়ায় ব্যাংকে আসবে, তখন আমদানি করা শুল্ক ফেরত দেওয়া হোক।
কাজেই সরকার আমাদের এ ২৫ শতাংশ ফেরত দেওয়ার দাবির বিপক্ষে গত বছর ১৫ শতাংশ বিকল্প নগদ সহায়তা ফেরত দিতে রাজি হয়েছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। তারপরও আমরা খুশি। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বিশ্বের ৫০ শতাংশ ফার্নিচারের চাহিদা পূরণ করে চীন। দেশটির শ্রমিক মজুরি তুলনামূলক বেশি। তাই তারা এ খাত থেকে সরে এলে বাংলাদেশসহ অনেক দেশই এর চাহিদা পূরণ করতে পারবে।
বিশ্ববাজারে আমরা ফার্নিচারের চাহিদা পূরণ করতে পারব। কারণ এখানে কম খরচে পর্যাপ্ত শ্রমিক পাওয়া সম্ভব। আর এ কারণেই আমাদের তৈরি পোশাক খাত সুনাম অর্জন করেছে। তৈরি পোশাক খাতে প্রচুর পরিমাণ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। আর আমাদের দেশে ২৫ থেকে ৩০ বছরের বেকারের সংখ্যাই বেশি। এতে স্বল্প খরচে শ্রমিক পাওয়া যায় এবং এটাই প্রকৃতপক্ষে এ খাতের মূল সুবিধা। তাই তৈরি পোশাক খাতে যেমন প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়, তেমনি ফার্নিচার খাতেও দরকার। কাজেই ফার্নিচার খাতও কিন্তু সে জায়গাটি দখল করতে পারে। ফলে দেশে এখন শুল্কসহ আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হলে ফার্নিচারশিল্প অনেক দূর যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আশা করি সরকার এ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে। বর্তমানে তৈরি পোশাক খাতের যে অবস্থান, তা আগামী ১০ বছরে ফার্নিচার খাতেও হতে পারে।
নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ফার্নিচার খাত কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?
ফার্নিচার খাতকে যদি একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় আনা যায়, তাহলে বর্তমানে তৈরি পোশাক খাত নিয়ে আমাদের যে সুখানুভবটি আছে, তা এ খাতেও থাকবে। তৈরি পোশাক খাত দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে, যা অন্য কোনো খাত রাখতে পারছে না। এ একটি খাতের ওপর নির্ভর করে কোনো দেশ চলতে পারে না। তাই আমি মনে করি, নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত দেশের কোন কোন খাতে সহযোগিতা করলে তৈরি পোশাক খাতের মতো অবস্থানে যেতে পারবে, তা খুঁজে বের করে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করা। এতে অর্থনীতি বড় হবে। দেশ দ্রুত তার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাবে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, দেশে অনেক শিল্প-কারখানা আছে, যেখানে খুব বেশি শ্রমিকের প্রয়োজন নেই, শুধু মেশিন দিয়েই কাজ হয়ে যায়। এতে বেকারত্ব কমে না কিন্তু অনেক শিল্প-কারখানা আছে যেখানে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন। আর সরকারের অন্যতম একটি লক্ষ্য হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা। তাই সরকারের ওইসব শিল্প-কারখানার দিকে বেশি নজর দেওয়া দরকার।
আসবাবশিল্পের উন্নয়নে আর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
দু’রকম উপায়ে ফার্নিচার তৈরি করা যায়। কোনো প্রতিষ্ঠানে ছোট কক্ষে পাঁচ থেকে সাতজন কার্পেন্টার আসবাব তৈরি করেন। এখানে প্রযুক্তিগত সম্পৃক্ততা কম। অন্যদিকে কারখানায় অনেক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পণ্য তৈরি করা হয়। সাধারণত বড় কারখানাগুলোয় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হ।।
এজন্য দক্ষ মেশিন অপারেটর দরকার। পাশাপাশি আসবাবের উন্নতি ও নকশার জন্য দরকার দক্ষ ডিজাইনার। আর ডিজাইনারের কাজ হবে কীভাবে স্বল্প উপকরণ ব্যবহার করে পণ্য তৈরি করা যায়। বসতবাড়ির আকার অনুযায়ী মানানসই পণ্যের নকশা করাসহ বিভিন্ন দিক নিয়ে বিবেচনা করা উচিত।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, দেশে এ ধরনের কোনো শিক্ষাব্যবস্থা বা পড়ালেখার সুযোগ নেই, যা বাইরের অনেক দেশে আছে। একজন কারিগরের পক্ষে পণ্যের ভালো ডিজাইন করা সম্ভব নয়। উদ্যোক্তার পক্ষেও এটি কষ্টসাধ্য। তাছাড়া প্রডাক্ট ডিজাইন শুধু ফার্নিচারের জন্য নয়, বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রেও প্রয়োজন। তাই সরকার কিংবা ব্যক্তিমালিকানাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে পারে।
আগামী ১০ বছর পর হাতিলকে কোন অবস্থানে দেখতে চান?
আমি চাই ১০ বছর পর দেশের সব মানুষের ঘরে অন্তত একটি করে হাতিলের ফার্নিচার থাকুক। মানুষ যেখানেই থাকুক, তার একটি খাট অথবা চৌকি লাগে। যেমন যারা মেসে থাকেন, তাদের সুন্দর একটি খাট না থাকলেও চৌকি অবশ্যই থাকে। সেটিও কিন্তু একটি ফার্নিচার। এখন কথা হলো, তারা হয়তো ওই চৌকিটি আনুমানিক দুই হাজার টাকা দিয়ে কিনেছেন কিন্তু সেটির মান ভালো নয়। এখন দুই হাজার টাকার উপযোগী পণ্য যদি বানানো যায় এবং সেটি যদি শিল্পগত প্রক্রিয়ায় হয়, তাহলে তা ভালো পণ্য হতে পারে। এসব দিক বিবেচনায় যে যেখানেই থাকুক, সবারই ফার্নিচারের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া বাসায় কোনো অতিথি এলেও বসার জন্য একটি চেয়ারের প্রয়োজন হয়। কাজেই আসবাব একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। এটি এখন আর বিলাসদ্রব্য নয়। তাই আসবাবও অন্যতম একটি মৌলিক চাহিদা বলে মনে করি। যে কারণে আমরা চেষ্টা করছি, কীভাবে গুণগত মান বজায় রেখে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে হাতিলের ফার্নিচার আনতে পারি।