সফল ব্যবসায়ী আবদুল কাদির মোল্লার একসময় পুঁজি ছিল মাত্র চার টাকা। মানুষের জমিতে ও ইটখোলায় কাজ করে তিনি পুঁজি জমিয়েছেন। জীবনের প্রথম উপার্জন চার টাকা বিনিয়োগ করেছেন তার শিক্ষায়। তারপর তিন বছর টেকনিক্যাল এডুকেশন কোর্স করেন। সার্টিফিকেট নিয়ে চলে যান সিঙ্গাপুরে। সেখানে পাঁচ বছর চাকরি করেন। চাকরি করে পুঁজি আহরণ শেষে দেশে ফিরে ব্যবসার প্রস্তুতি নেন।এখন তার হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। বর্তমানে তিনি সফল উদ্যোক্তা এবং দানবীর হিসেবে সর্বত্র সমাদৃত।
এক সময় আমাদের এই দেশটা গরিব দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন একটু একটু করে দেশটা এগিয়ে যাচ্ছে। স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে আমাদের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে। এর কারণ, আমাদের জমির পরিমাণ কম। আমরা কাউকে জমি বা সম্পত্তি দিয়ে বড় করতে পারব না। সে ক্ষেত্রে একটাই পথ আছে। সেটা হচ্ছে, গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা।প্রজন্মকে যদি সঠিক এবং মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া যায়, তাহলে তারা জাতীয় সম্পদে পরিণত হবে। এতে শিক্ষার মান যেমন বাড়বে অপরদিকে বেকারত্ব দূর হবে। মজবুত হবে দেশের অর্থনীতি। কথাগুলো বলছিলেন রপ্তানিতে দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থার্মেক্স গ্রুপের এমডি ও নরসিংদী সিটি কলেজের চেয়ারম্যান আবদুল কাদির মোল্লা।
তিনি বলেন, দেশের শিক্ষা খাতকে এগিয়ে নিতে ১৯৯৫ সালে মনোহরদীর পাচকান্দি ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে যাত্রা শুরু। মানসম্মত শিক্ষা প্রদানে নরসিংদী সদরে আবদুল কাদির মোল্লা সিটি কলেজ, এন কে এম হাইস্কুল ও আবদুল কাদির মোল্লা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ইতিমধ্যে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজ অবস্থান আলোকিত হয়ে উঠেছে। আমাদের দেখাদেখি অন্য শিক্ষাঙ্গনগুলোও উদাহরণস্বরূপ দেখছে। অর্থাৎ জেলাব্যাপী শিক্ষা বিপ্লবের একটা ডাক পড়ে গেছে। নরসিংদী জেলা যদি শিক্ষা-সমৃদ্ধি হয়ে ওঠে, তাহলে আশপাশের জেলাগুলোও এভাবে এগিয়ে আসবে।একদিন এর বাতাস দেশব্যাপী বইবে।
এ ছাড়া বিভিন্ন ইউনিয়ন, থানা, উপজেলা, জেলাব্যাপীসহ আশপাশের জেলা, এমনকি সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমার সামর্থ্য অনুযায়ী অনুদান দিয়ে যাচ্ছি। যাতে করে শিক্ষার মানকে সমুন্নত রাখা সম্ভব হয়। থার্মেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল কাদির মোল্লা বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়ার চিন্তা করা যাবে না। তাহলে প্রতিষ্ঠান কখনো ভালো করবে না।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সাফল্যটাকেই নিজের অর্জন হিসেবে ধরে নিতে হবে। শিক্ষা খাতে পুঁজি খাটিয়ে সেখান থেকে লভ্যাংশের আশা করলে শিক্ষাটা আর মানসম্মত হবে না। তখন সেটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নেবে। আর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কখনো সঠিক জ্ঞান লাভ করবে না।
জেনারেল শিক্ষার পাশাপাশি আগামী দিনে বেকারত্ব দূরীকরণসহ শিক্ষার মান ধরে রাখতে কারিগরি শিক্ষাকেও প্রাধান্য দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। এক সময়ের কষ্ট আর ক্ষুধার জ্বালায় নিষ্পেষিত কাদির মোল্লা এখন সফল ব্যবসায়ী। সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন আইডল। গড়ে তুলেছেন একাধিক রপ্তানিমুখী শিল্প ও মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এখন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দুই হাত ভরে দান করছেন। উদ্ধার করছেন কন্যাদায়গ্রস্ত মাতা-পিতাদের। ভূমিহীনদের নির্মাণ করে দিচ্ছেন পাকা ঘর। শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ যারাই দুরারোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের চিকিৎসার ব্যয়ভার গ্রহণ করে দেখাচ্ছেন জীবনের নতুন আলোর পথ।শত ব্যস্ততার মধ্যেও সপ্তাহের একটি দিন রেখেছেন সাধারণ মানুষের কথা শোনার জন্য। সেখানে কারও ভর্তির জন্য অর্থের সমস্যা, চিকিৎসার জন্য অর্থের সমস্যা আবার বিয়ে দেওয়ার টাকা নেই। খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে না কাউকে। তাই নরসিংদী ও আশপাশ অঞ্চলের মানুষের কাছে দানবীর কাদির মোল্লা উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, ব্যবসার উদ্দেশ্য শুধু মুনাফা নয়, মানবকল্যাণও। দানের মধ্য দিয়ে যে আত্মতৃপ্তি লাভ করা যায়, তা আর কোনোটার মধ্যেই নেই। তাই নিজের আত্মতৃপ্তি, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে বহু মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন ব্যক্তিশ্রেণির এই করবাহাদুর। তবে তিনি কখনো রাজনীতিতে আসবেন না।
আবদুল কাদির মোল্লা আরও বলেন, রাজনীতি করা আমার কাজ নয়। এক সময় সুবিধাবঞ্চিত ছিলাম। তাই সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলো কী ধরনের কষ্ট পায়, কী কী বিষয় তাকে পীড়া দেয়, আঘাত দেয়, সে অনুভূতিটা আমি বুঝি। তবে আমি সুবিধাবঞ্চিত ছিলাম বিধায় এ ধরনের কাজ করছি এটা ভুল।
একটা উপলব্ধি থেকে, নিজের একটা দায়িত্ববোধ থেকে কাজগুলো করছি। তা ছাড়া মানুষ হিসেবে এটা আমার সামাজিক দায়বদ্ধতা, ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা। আমি যদি কারও জন্য কিছু করতে পারি তাহলে দীর্ঘমেয়াদি আত্মতৃপ্তি থাকবে। এ থেকে আমার সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করলাম, আমিও খুশি থাকলাম, পক্ষান্তরে মানুষও উপকৃত হলো।
সফল ব্যবসায়ী আবদুল কাদির মোল্লার এক সময় পুঁজি ছিল মাত্র চার টাকা। মানুষের জমি ও ইটখোলায় কাজ করে তিনি পুঁজি জমিয়েছেন। জীবনের প্রথম উপার্জন চার টাকা বিনিয়োগ করেছেন তার শিক্ষাজীবনে। তার পর ৩ বছর টেকনিক্যাল এডুকেশন কোর্স করেন। সার্টিফিকেট নিয়ে চলে যান সিঙ্গাপুরে। সেখানে ৫ বছর চাকরি করেন। চাকরি করে পুঁজি আহরণ শেষে দেশে ফিরে ব্যবসার প্রস্তুতি নেন।
তিনি বলেন, বিদেশে চাকরি করে যে পুঁজি এনেছি তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একেবারেই স্বল্প। তা দিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। তাই করপোরেট জব করলাম তিতাস গ্যাসের একটি সংস্থায়। তিতাস গ্যাসের চাকরি নিয়ে পরে যখন বুঝলাম পরিবেশ ভালো না। এখানে রাজনীতি করলে ভালো থাকা যায়। রাজনীতি করলে ভালো জায়গায় পোস্টিং নেওয়া যায়। নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিনি। তাই চাকরি ছেড়ে দিলাম। সিঙ্গাপুর থেকে আনা অর্থ ব্যাংক ও স্টক বিজনেসে খাটিয়ে পুঁজি বাড়িয়েছি। তারপর প্রথমে সাড়ে ৪ লাখ টাকায় জমি ক্রয় করি। পরে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি শুরু করি। ইন্ডাস্ট্রি চালু হয়ে গেলে তখন একের পর এক পুঁজি বাড়তে থাকে। পরে অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর কঠোর পরিশ্রমে নরসিংদীতে তিলে তিলে গড়ে তুলেছি রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান থার্মেক্স গ্রুপ।
দেশের অন্যতম তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থার্মেক্স গ্রুপে একে একে যোগ হয়েছে ডেনিম, স্পিনিং, উইভিং, নিটিং, ডায়িং, ফিনিশিং, প্রিন্টিং এবং গার্মেন্টসহ নানা ইউনিট। প্রতি বছরই লাভের আয় থেকে একটি করে ইউনিট বাড়িয়েছি। একপর্যায়ে যখন লাইন ইউনিটে চলে এসেছি তখনই শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে নাম এলো। আমি পরিচিত হতে লাগলাম।যত আয় বাড়ছে দায়-দায়িত্ব তত বেশি বাড়ছে। মানুষের প্রতি দায়ভার, সামাজিক দায়ভার ও দায়-দায়িত্ব আরও বেশি বেড়ে গেছে। তখন থেকেই মানুষের কল্যাণে নিজেকে কাজে লাগানোর চেষ্টা শুরু করি। আল্লাহ যদি আমার সহায় হয় ইনশাল্লাহ আরও বেশি সামনে যাব। তত বেশি মানুষ আমার দ্বারা উপকৃত হবে।
শিক্ষা ও ব্যবসায়ী জীবনের প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিবন্ধকতা ছাড়া কোনো কাজই নেই। শুধু ব্যবসা জীবন না, সাধারণ জীবনেও অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকে। তবে সৎ ইচ্ছা, সৎ চিন্তা ও সৎ শ্রম থাকতে হবে। আপনার চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি, দর্শন, সততা, ধৈর্য ও সাহস যদি ঠিক থাকে, তাহলে কোনো কাজকেই বাধা দিয়ে থামানো যাবে না।
সম্প্রতি কাদির মোল্লা ও তার পরিবারকে করবাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করেছে সরকার। দেওয়া হয়েছে সম্মাননা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দীর্ঘ ২৮ বছর কর দেওয়ার পর সরকার আমার পরিবারকে করবাহাদুর পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটা আমার জীবনের বড় অর্জন। এ সম্মান শুধু আমার নয়, এ সম্মান পুরো নরসিংদীবাসীর সম্মান।
কর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারকে কর দিয়ে আমরা নিজেদেরই সমৃদ্ধ করছি। কারণ করের টাকা সরকার আমাদের পেছনেই ব্যয় করছে। এর সুফল ভোগ করবে আমাদের সন্তানসহ আগামী প্রজন্ম। সবাই যখন এ বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারবে, বুঝতে পারবে, তখন যারা কর দেওয়া থেকে বিরত আছেন তারাও কিন্তু কর দেওয়ার পক্ষে এগিয়ে আসবেন। তা ছাড়া কর আদায়ের পক্ষে এনবিআর কর মেলাসহ বিভিন্ন প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন ( প্রকাশ : শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৭)