তুরস্কের রাজনীতিতে রেচেপ তাইয়েপ এরদোগান এখন এক শক্তিমান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। আধুনিক তুরস্কের জনক হিসেবে পরিচিত মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের পর তুরস্কের রাজনীতিতে এতোটা পরিবর্তন অন্য কোন নেতা আনতে পারেননি।নির্বাচনের মাধ্যমে এরদোগানের ক্ষমতা আরো পাকাপোক্ত হয়েছে বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। তুরস্কের নতুন সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে এরদোগান একচ্ছত্র আধিপত্য ভোগ করবেন। এরদোগানের একে পার্টি রক্ষণশীল ইসলামী মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত।
তুরস্কের রাজনীতিতে ১৯৬০’র দশক থেকে চারবার সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে এরদোগান যেভাবে সামরিক অভ্যুত্থান নস্যাৎ করে দিয়েছেন, তাতে ক্ষমতার উপর তাঁর অবস্থান আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। এরদোগানের সমর্থকরা মনে করেন, তিনি দেশটির ডুবন্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলেছেন। কিন্তু সমালোচকদের দৃষ্টিতে তিনি একজন স্বৈরশাসক যিনি ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্দয়ভাবে দমন করেন।
তুরস্কের একে পার্টি প্রতিষ্ঠিত হবার এক বছর পর ২০০২ সালে ক্ষমতায় এসেছেন এরদোগান। ২০১৪ সালে তুরস্কে অনুষ্ঠিত প্রথম সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হবার আগ পর্যন্ত এরদোগান ১১ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তখন প্রেসিডেন্ট ছিল শুধুই একটি আনুষ্ঠানিক পদ। প্রেসিডেন্টের হাতে তেমন কোন ক্ষমতা ছিল না। এরদোগানের জন্ম ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তাঁর বাবা ছিলেন তুরস্ক কোস্ট গার্ডের একজন সদস্য।এরদোয়ানের বয়স যখন ১৩ বছর তখন তাঁর বাবা ইস্তাম্বুলে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল পাঁচ সন্তানকে ভালো লেখাপড়া শেখানো।
তরুণ বয়সে এরদোগান বাড়তি উপার্জনের জন্য লেবুর শরবত এবং বিভিন্ন খাবার বিক্রি করতেন। ইস্তাম্বুলের মারমারা ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন তিনি। এর আগে তিনি একটি ইসলামিক স্কুলে পড়াশুনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সময় পেশাদার ফুটবলও খেলেছেন এরদোয়ান।
১৯৭০ -১৯৮০: তিনি ইসলামপন্থী একটি রাজনৈতিক দল নেকমেতিন এরবাকানস ওয়েলফেয়ার পার্টর সাথে সক্রিয় ছিলেন।
১৯৯৪-১৯৯৮: ইস্তাম্বুলের মেয়র ছিলেন। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে এবং ওয়েলফেয়ার পার্টিকে নিষিদ্ধ করে।
১৯৯৯: তাঁর চার মাসের কারাদণ্ড হয়। তিনি জনসম্মুখে একটি কবিতা পাঠ করেছিলেন। কবিতাটি ছিল এ রকম, “মসজিদ হচ্ছে আমাদের ব্যারাক, গম্বুজ হচ্ছে আমাদের হ্যালমেট এবং মিনার হচ্ছে আমাদের বেয়নেট।”
২০০১: আগস্ট মাসে তিনি আবদুল্লাহ গুলের সাথে মিলে ইসলামপন্থী একে পার্টি গঠন করেন।
২০০২-২০০৩: সংসদ নির্বাচনে একে পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং এরদোগান প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
২০১৪: আগস্ট মাসে দেশটিতে অনুষ্ঠিত প্রথম সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হন।
২০১৬: জুলাই মাসে এক সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা নস্যাৎ করে দেন তিনি।
২০১৭: এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত গণভোটে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়।
তুরস্কের উপর ইসলামিক মূল্যবোধ চাপিয়ে দেবার কথা অস্বীকার করেন এরদোগান। নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে মনে করেন তিনি। তবে তুরস্কের লোকজন তাদের ধর্ম বিষয়ে খোলাখুলি-ভাবে কথা বলতে পারার বিষয়টিকে সমর্থন করেন মি: এরদোগান। তাঁর এ বার্তা গ্রামাঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এরদোগানের কিছু সমর্থক তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্যের সাথে তুলনা করে তাঁকে ‘সুলতান’ নামে ডাকে।
চার সন্তানের জনক এরদোগান মনে করেন মুসলিমদের জন্মনিয়ন্ত্রণ করা উচিত নয়। তাদের যত সম্ভব সন্তান নেয়া উচিত। তুরস্কের প্রেসিডেন্টের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করে রাজধানী আঙ্কারায় একটি প্রাসাদ তৈরি করেছেন এরদোগান। সে প্রাসাদের নামকরণ করা হয়েছে ইংরেজিতে তার অর্থ ‘হোয়াইট প্যালেস’। এক হাজার কক্ষ আছে সে প্রাসাদটিতে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের দপ্তর হোয়াইট হাউজ কিংবা রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের দপ্তর ক্রেমলিনের চেয়ে এটি বড়।
এ প্রসাদ তৈরি করতে খরচ হয়েছে ৪৮২ মিলিয়ন ডলারের বেশি। এরদোগানের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে তুরস্কের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। দেশটিকে এখন গড়ে ৪.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এরদোগান প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট আছেন। সিরিয়ার যুদ্ধে তিনি প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরোধীদের মদদ দিচ্ছেন। মিশরে ক্ষমতাচ্যুত মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিও সমর্থন ব্যক্ত করেছেন এরদোগান।