উত্তর আমেরিকার দরিদ্রতম দেশ হাইতির প্রেসিডেন্ট জোভেনেল মোইসিকে বুধবার গভীর রাতে নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করে একদল ভাড়াটে সেনা।
হাইতির রাজধানী পোর্টো প্রিন্সের যে পাহাড়ে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ সেখানে ভারী অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত একদল লোক ৫৩ বছর বয়সী প্রেসিডেন্টের ওপর কয়েকবার গুলি চালায় এবং তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।
এ নিয়ে বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- একজন ম্যাজিস্ট্রেট কার্ল হেনরি ডেসটিন পরে স্থানীয় এক সংবাদপত্রকে জানিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্টের দেহে মোট ১৪টি বুলেট পাওয়া গিয়েছিল। তার অফিস এবং বেডরুম তছনছ করা হয়, এবং তার লাশ পড়ে ছিল চিৎ হয়ে, দেহ রক্তে ভেসে যাচ্ছিল।
হামলায় আহত হন ৪৭-বছর বয়সী ফার্স্ট লেডি।
চিকিৎসার জন্য তাকে জরুরি ভিত্তিতে নিয়ে যাওয়া হয় ফ্লোরিডায়। সেখানে তার অবস্থা এখনো সংকটজনক।
প্রেসিডেন্টের তিন সন্তান, জোমারলি, জোভনেল জুনিয়র এবং জোভারলেইন একটি নিরাপদ স্থানে আছেন বলে জানিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা।
তবে বুধবার রাতে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে যে নির্মম ঘটনা ঘটেছিল, সেখানেই তা শেষ হয়নি।
কয়েক ঘণ্টা পর পোর্টো প্রিন্সে পুলিশ এবং কথিত আততায়ীদের মধ্যে এক মারাত্মক বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়।
হাইতির পুলিশ প্রধান লিওন চার্লস বলেছেন, চারজন সন্দেহভাজন নিহত হয়েছে এবং দুজন ধরা পড়েছে। অন্যান্য পলাতক সন্দেহভাজনদের ধরতে অভিযান চলছে।
তাদের হয় ধরা হবে নয়তো হত্যা করা হবে, বলছেন মি. চার্লস।
প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে এই হামলার পেছনে কারা?
অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্লদ জোসেফ এই বন্দুকধারীদের ‘ভাড়াটে সেনা’ বলে বর্ণনা করছেন।
তিনি বলেছেন, এরা ছিল বিদেশি, কথা বলছিল ইংরেজি এবং স্প্যানিশ ভাষায় (হাইতির সরকারি ভাষা হচ্ছে ক্রিও এবং ফরাসি)।
পুলিশ বলছে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আছে একটি ‘হিট স্কোয়াড’।
পুলিশ প্রধান লিওন চার্লস জানিয়েছেন, সন্দেহভাজনদের মধ্যে ২৬ জন কলম্বিয়ান এবং দু’জন মার্কিন নাগরিক।
ঘটনার প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে পুলিশ এই সন্দেহভাজনদের মধ্যে ১৭ জনকে গ্রেফতার করে এবং তাদের সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়।
সেখানে ঘটনার প্রমাণ হিসেবে তাদের পাসপোর্ট এবং হামলায় ব্যবহৃত অ্যাসল্ট রাইফেল, চাপাতি এবং হাতুড়ি প্রদর্শন করা হয়।
আট জন সন্দেহভাজন এখনো পলাতক। বাকি সন্দেহভাজনরা রাজধানী পোর্টো প্রিন্সে পুলিশের সঙ্গে এক বন্দুকযুদ্ধের সময় গুলিতে নিহত হয়।
কর্তৃপক্ষের প্রকাশ করা ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ভারী অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত এবং কালো পোশাক পরা বন্দুকধারীরা প্রেসিডেন্টের বাড়ির বাইরে এসে ইংরেজিতে চিৎকার করছে, এটা ডিইএ’র (ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট এডমিনিস্ট্রেশন, যুক্তরাষ্ট্রের মাদক দমন সংস্থা) একটা অভিযান, সবাই চুপ থাকো।
ওয়াশিংটনে হাইতির রাষ্ট্রদূত বোচিট এডমন্ড বলেন, হামলাকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের মাদক দমন সংস্থার ছদ্মবেশে আসলেও এরা যে মার্কিন এজেন্ট ছিল, সেটা তার মোটেই বিশ্বাস হয় না।
রাষ্ট্রদূত এডমন্ড একটি টিভি চ্যানেল এনটিএন২৪কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার এই কাজের জন্য তাদের অর্থ দিয়ে ভাড়া করা হয়েছে। আমি আশা করবো তারা আসলে কার হয়ে কাজ করছিল, সেটি তারা প্রকাশ করবে।
পুলিশ কর্মকর্তারা যখন কথিত হামলাকারীদের মোকাবিলা করছিল, সেই নাটকীয় দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন পুলিশ প্রধান লিওন চার্লস। তিনি বলেন, ঘটনাস্থল থেকে যখন তারা পালাচ্ছিল, তখন আমরা তাদের পথ আটকে দেই। তারপর হতে তাদের সঙ্গে আমাদের লড়াই চলছিল।
কর্মকর্তারা বলছেন, এই সন্দেহভাজনদের কাছে বেশ ভালো অস্ত্র-শস্ত্র ছিল এবং তারা তিন জন পুলিশ সদস্যকে জিম্মি করেছিল। পরে তারা মুক্তি পেয়েছিলেন।
জোভেনেল মোইসি যেভাবে ক্ষমতায় আসেন
জোভেনেল মোইসি রাজনৈতিক জীবনে লাতিন আমেরিকার অন্যান্য নেতাদের মতো নয়।
তিনি জীবন শুরু করেন একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে। হাইতির জনসংখ্যা এক কোটি দশ লাখ, এটিকে পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ বলে গণ্য করা হয়।
চার বছর আগে ২০১৭ সালে তিনি হাইতির প্রেসিডেন্ট হন। ২০১৯ সালের অক্টোবরে নতুন পার্লামেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই নির্বাচন নিয়ে বিরোধ দেখা দেয় এবং তা পিছিয়ে দেওয়া হয়।
এর পরিণামে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মোইসির মেয়াদ বাড়ানো হয় এবং তিনি ডিক্রি জারি করে এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করছিলেন।
প্রেসিডেন্ট মোইসির চার বছরের মেয়াদে হাইতিতে ছয় বার প্রধানমন্ত্রী বদল হয়েছে। সর্বশেষ গত সোমবার, প্রেসিডেন্ট মোইসি নিহত হওয়ার আগের দিন, তিনি সপ্তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এরিয়েল হেনরিকে নিয়োগ করেন। কিন্তু নতুন প্রধানমন্ত্রী আর শপথ নিতে পারেননি।
কাজেই প্রেসিডেন্ট মোইসি নিহত হওয়ার পর এখন আগের প্রধানমন্ত্রী ক্লদ জোসেফই দায়িত্ব পালন করছেন।
হাইতিতে এখন চরম অনিশ্চয়তা চলছে কে দেশ চালাবে তা নিয়ে।
নানা গুজব, অনেক প্রশ্ন
অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী ক্লদ জোসেফ বলেছেন, প্রেসিডেন্ট মোইসির হত্যাকাণ্ড হাইতিকে এক বড় ধাক্কা দিয়েছে।
তবে প্রেসিডেন্ট নিহত হওয়ার আগেই তার উপরে চাপ বাড়ছিল।
তার শাসনামলে দুর্নীতির অভিযোগ এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ওঠে এবং দেশটি রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। তার পদত্যাগের দাবিতে গণবিক্ষোভ চলছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার অধ্যাপক রবার্ট ফ্যাটনের জন্ম হাইতিতে। তিনি বলছেন, এটি হাইতির ইতিহাসের সবচেয়ে ষড়যন্ত্রমূলক একটি ঘটনা।
তিনি বলেন, হাইতির ইতিহাস দারিদ্র, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, স্বৈরতন্ত্র এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে ভরা। কিন্তু এবারের ঘটনাটি খুবই বিচলিত হওয়ার মতো। হাইতির মতো একটি অস্থিতিশীল দেশের জন্যও একজন প্রেসিডেন্টকে এভাবে হত্যার ঘটনা খুবই অস্বাভাবিক এবং গভীর উদ্বেগর বিষয়। আপনি যখন কোনো রাজনৈতিক অবস্থান থেকে এটি বিশ্লেষণ করবেন, এটা কল্পনা করাও আসলে কঠিন, কারা এই কাজ করেছে, এবং কেন?
‘প্রেসিডেন্টকে হত্যা হাইতিকে চরম বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিল। আর অতীতে আমরা যেরকমটা দেখেছি, এরকম রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব পড়তে পারে পুরো অঞ্চলের ওপর’, যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, এরপর কী ঘটবে, এত তাড়াতাড়ি হয়তো সেটা অনুমান করা কঠিন। তবে এতটুকু পরিষ্কার হাইতির আশু ভবিষ্যত অন্ধকার।
করোনাভাইরাস মহামারি আঘাত হানার আগে থেকেই হাইতি নানা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছিল। এখন নতুন করে যুক্ত হওয়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা হয়তো হাইতিকে খাদের কিনারে ঠেলে দেবে।
সরকার এরই মধ্যে দুই সপ্তাহের জন্য দেশজুড়ে ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছে। বলা হচ্ছে, আততায়ীদের ধরা এবং এবং সম্ভাব্য সামাজিক অস্থিরতা দমনের জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ক্লদ জোসেফ বলেছেন, দেশে যাতে ধারাবাহিকতা বজায় থাকে, তার জন্য সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের জয় হবেই।
নির্মমভাবে হত্যার এই ঘটনা পুরো দেশকে যেভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে, তারপর প্রধানমন্ত্রী জোসেফ দেশের ওপর কতটা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারবেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে।