দেশের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র ঢাকা মহানগর। এই নগরে যে দল রাজনৈতিক শক্তি ধরে রাখতে পেরেছে, তারাই রাষ্ট্র চালানোর দায়িত্ব পেয়েছে। একসময় ঢাকা মহানগর বিএনপির দুই কাণ্ডারীর একজন ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা, অন্যজন মির্জা আব্বাস। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিএনপির সঙ্গে সাদেক হোসেন খোকার সম্পর্ক ছিন্ন হলেও মির্জা আব্বাস রয়েছেন দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে।
কিন্তু সম্প্রতি বিএনপির সঙ্গে মির্জা আব্বাসের সম্পর্কে যেন দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর ‘নিখোঁজ’ হওয়ার বিষয়ে তার এক বক্তব্যে এই দূরত্ব আরও প্রকট হয়েছে। এই দূরত্বের জেরে আব্বাসের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ছিন্ন হতে পারে বলেও গুঞ্জন চলছে দলের অন্দরে। যদিও রাজনীতি-সংশ্লিষ্টরা এই ইস্যুতে বিএনপি এবং আব্বাস—উভয়পক্ষকেই বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
ঢাকায় বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন না জমাতে পারার পেছনে এখানকার রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক মির্জা আব্বাসকে দীর্ঘদিন ধরে দুষে আসছে তার সমালোচক একটি পক্ষ। যদিও পল্টন, মতিঝিল, খিলগাঁও, শাহজাহানপুরসহ ঢাকা দক্ষিণের অনেক এলাকায় মির্জা আব্বাসের অনুসারী নেতাকর্মীরাই আন্দোলনে সরব থাকেন বলে দাবি তার পক্ষের রাজনীতিকদের।
এর মধ্যে গত ১৭ এপ্রিল দুপুরে এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় মির্জা আব্বাস দলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর ‘নিখোঁজ’ হওয়ার বিষয়ে নতুন তত্ত্ব দেন। ৯ বছর আগে ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকার বনানী থেকে গাড়িচালক আনসার আলীসহ নিখোঁজ হয়েছিলেন ইলিয়াস আলী।
ঢাকাস্থ সিলেট বিভাগ জাতীয়তাবাদী সংহতি সম্মেলনীর উদ্যোগে আয়োজিত ওই সভায় মির্জা আব্বাস বলেন, ‘ইলিয়াস আলী ‘গুমে’র নেপথ্যে সরকার নয়, বিএনপির লোকই রয়েছে।’
এ নিয়ে বিএনপি তথা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। দলীয় হাইকমান্ডের চাপের মুখে পড়েন আব্বাস। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির এই নেতা তার বক্তব্য বিকৃত করার দায় চাপান গণমাধ্যমের ওপর।
দলীয় সূত্র জানায়, ওই সংবাদ সম্মেলনে মির্জা আব্বাসের দেয়া বক্তব্য ভালো লাগেনি বিএনপির হাইকমান্ডের। বরং তার প্রতি আরও ক্ষুব্ধ হয়েছে শীর্ষ নেতৃত্ব। কারণ হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে মির্জা আব্বাসকে একটি লিখিত দেয়া হয়েছিল, বলা হয়েছিল সংবাদ সম্মেলনে তিনি শুধু ওই চিঠি পাঠ করবেন। কিন্তু সেটা না করে তিনি তার ‘মনমতো’ বক্তব্য দিয়েছেন।
এ কারণে ইলিয়াস আলীর ‘নিখোঁজ’ হওয়ার বিষয়ে দেয়া তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা চেয়ে গত ২২ এপ্রিল আব্বাসকে নোটিশ পাঠায় বিএনপি। যদিও এ ধরনের কোনো নোটিশ পাওয়ার বিষয়টি আব্বাস অস্বীকার করে চলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যদি এ ধরনের চিঠি দেয়া হয়ে থাকে তবে সেটা দুর্ভাগ্যজনক।’ তাছাড়া আব্বাস নিজের বক্তব্য থেকে ‘ইউটার্ন’ করবেন না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে বিএনপির সর্বমহলে নানা আলোচনা চললেও কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না।
একাধিক সূত্র বলছে, কোন্দলের ধারাবাহিকতায় বিএনপির একটি অংশ মির্জা আব্বাসকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে চায়। তারা এখন আব্বাসের ‘বেফাঁস’ বক্তব্যের সুযোগ নিচ্ছে। যদিও ইলিয়াস আলী ইস্যুতে আব্বাস যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা দলের নীতির পরিপন্থী। তবে বিষয়টি নিয়ে আব্বাসের বিরোধীপক্ষ যেভাবে তাকে ‘শিক্ষা দেয়ার’ মিশনে নেমেছে, তাতে একসময়ের এই প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে দলটির সম্পর্কও ছিন্ন হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হতে পারে। আর তা যদি হয়, তাতে ব্যক্তি মির্জা আব্বাস যেমন কিছুটা বেকায়দায় পড়বেন, তেমনি বর্তমান পরিস্থিতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিএনপিও।
বিএনপিপন্থী রাজনীতি-বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইলিয়াস আলী ইস্যুতে ‘বেফাঁস’ বক্তব্য দেয়ার পর মির্জা আব্বাসকে দিয়ে সংবাদ সম্মেলন না করিয়ে এই ইস্যুতে হাইকমান্ড সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিতে পারতো, তাতে অনেক বিতর্কই এড়ানো যেতো। তাছাড়া, মির্জা আব্বাসকে দলের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনের জন্য যে চিঠি দেয়া হয়েছে, সে ব্যাপারেও কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা উচিত ছিল।
আব্বাসের প্রতি সহনশীল এমন একাধিক বিএনপি নেতার মতে, হাইকমান্ডের উচিত হবে মির্জা আব্বাসের প্রতি সর্বোচ্চ সহানুভূতি রাখা, কারণ তিনি কোনো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন, এটা তার অনুসারীদের কেউ বিশ্বাস করবে না। তিনি হয়তো বক্তৃতায় রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি করেছেন। এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে দল এবং আব্বাসের অস্বস্তি দূর করার দায়িত্ব হাইকমান্ডের। আর আব্বাসেরও উচিত হবে ভুল বক্তব্যের জন্য অনুতপ্ত হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া। এর ব্যতিক্রম হলে সেটা বিএনপি বা আব্বাস—কোনো পক্ষের জন্যই ভালো হবে না।
এক্ষেত্রে ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও চৌধুরী তানবীর আহমেদ সিদ্দিকীর মতো নেতাদের সঙ্গে বিএনপির বিচ্ছেদের কথা তুলে ধরে ওই নেতারা বলছেন, ভুল বোঝাবুঝির কারণেই বদরুদ্দোজা ও তানবীর সিদ্দিকীরা বিএনপি ত্যাগ করেছেন, তাতে রাজনৈতিকভাবে তারা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, বিএনপিও কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তাই বিএনপি ও আব্বাস—উভয়পক্ষেরই দূরদর্শিতা দেখানো উচিত।
এদিকে আব্বাসকে বিএনপির তরফ থেকে গত ২২ এপ্রিল যে নোটিশ পাঠানো হয়েছিল, তার জবাব দেয়ার শেষ দিন আজ শনিবার (২৪ এপ্রিল)। এদিনই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক।
স্থায়ী কমিটির এ বৈঠকে তিনি অংশ নেবেন কি-না, জানতে চাইলে কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘সময় হলে জানতে পারবেন।’