‘লকডাউন’ বা সাধারণ ছুটি নয়, এবার বিধিনিষেধের পথ বেছে নিয়ে সরকার প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিল বলেই ধরে নেওয়া যায়। অর্থাৎ গত বছর সাধারণ ছুটির অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সরকারি-বেসরকারি অফিস ছুটি দিয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা—এই শ্রেণির মানুষদের ছাড় দেওয়া, কারণ গতবার তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন।
এবার সরকারের কঠোর বিধিনিষেধের তৃতীয় দিনেই যেন বাঁধ ভেঙে গেছে। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকেই ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যানবাহন ও মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। আজ শনিবার রাস্তাঘাট প্রায় স্বাভাবিক। অনেকে আবার পুলিশের মুভমেন্ট পাস নিয়ে ‘ঘুরতে’ বেরিয়েছেন। মূল সড়কে কিছুটা কড়াকড়ি থাকলেও পাড়া-মহল্লায় পুলিশের তৎপরতা নেই বললেই চলে। ফলে, ঢাকার কোনো মহল্লায় গেলে মনে হবে না বিধিনিষেধ বলে কিছু আছে। ইফতারের সময় অলিগলিতে যথারীতি ভিড় করে মানুষ ইফতার কিনছেন। গতবার প্রথম দিকে শুধু নিত্যপণ্যের দোকান ও কাঁচাবাজার খোলা ছিল। এবার মোটামুটি সব দোকানই খোলা থাকছে বেলা তিনটা পর্যন্ত।
গতবার সাধারণ ছুটির সময় দেখা গেছে, চাকরিজীবীরা ঘর থেকে না বেরিয়ে অনলাইনে অর্ডার করে বাজার করেছেন। তাতে এই মানুষদের বিশেষ অসুবিধা হয়নি, কারণ অফিসে যান বা না যান, বেতন পেতে সমস্যা হয়নি, যদিও অনেকের বেতন-বোনাস কমে গিয়েছিল। কিন্তু বিপাকে পড়েন শ্রমজীবী মানুষ। সাধারণ ছুটির মধ্যে এক সপ্তাহও ঘরে থাকার উপায় ছিল না তাঁদের। সেবার কড়াকড়ি বেশি ছিল বা প্রথম দিকে সবকিছু বন্ধ ছিল বলে কাজের সুযোগ ছিল খুব কম। তাই ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে খাবারের সন্ধানে তাঁদের ত্রস্ত ছোটাছুটির দৃশ্য ছিল অতি সাধারণ। সমাজ যেন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল—এক দলে ছিলেন তাঁরা, যাঁদের আয় কমেনি (কারও কারও আবার বেড়েছে), আরেক দিকে ছিলেন সেই মানুষেরা, যাঁরা আয় হারিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গিয়েছিলেন।
বাস্তবতা হলো, যে দেশের ৮৬ শতাংশ মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, যে দেশে দরিদ্র ও অরক্ষিত মানুষের তালিকা নেই, সেই দেশে পূর্ণাঙ্গ লকডাউন বাস্তবসম্মত নয়। সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের পক্ষে তা ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব নয়, রাজনৈতিক দলের কথা আর না বলাই ভালো। তবে লকডাউন দিয়ে বিশ্বের কোনো দেশে যে সংক্রমণ ঠেকিয়ে রাখা গেছে, তাও নয়। অন্যদিকে সরকার জানেই না, এ ধরনের পরিস্থিতিতে কারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায় বা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ফলে, সরকার যে জলদি সিদ্ধান্ত নিয়ে এ ধরনের বিধিনিষেধ কঠোরভাবে কার্যকর করবে, সেই উপায় নেই।
এ ক্ষেত্রে ভারতের আধার কার্ড বিশ্বস্বীকৃত মডেল। এটি একধরনের ডিজিটাল পরিচয়পত্র। এতে যেমন ব্যক্তির পেশা ও আয়ের তথ্য থাকে, তেমনি ব্যাংক হিসাবও যুক্ত থাকে। এটি থাকার কারণে ভারত সরকার গত বছর খুব দ্রুততার সঙ্গে অভিবাসী (অভ্যন্তরীণ) শ্রমিকদের নগদ সহায়তা দিতে পেরেছিল। অথচ দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে এমন ব্যবস্থা না থাকায় নাগরিকদের হাতে প্রেসিডেন্টের চিঠিসহ নগদ সহায়তার চেক পৌঁছে দিতে প্রশাসনকে রীতিমতো গলদঘর্ম হতে হয়। আর বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে প্রকল্প হাতে নিয়েও এখন পর্যন্ত দরিদ্র মানুষের তালিকা করে উঠতে পারেনি।
এদিকে গত বছরের মতো এবারও বৈশাখী উৎসব হলো না। তাতে শহরের কাপড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে গ্রামের কারুশিল্পী ও এসব পণ্যের ব্যবসায়ীরা মার খেয়েছেন। সামনে আছে দুটি ঈদ। তখন কী হবে এখনো কেউ জানে না। সরকার হয়তো ঈদের আগে দোকান মালিক সমিতির চাপে বিপণিবিতান খুলে দেবে, কিন্তু সামগ্রিক চাহিদা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কম থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবসায়ীদের বিদ্যুৎ বিল মওকুফ করাসহ ভাড়া ভর্তুকি, মূসকছাড় ও সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা।
করোনাভাইরাস যেভাবে আরও ভয়ংকর চেহারা নিয়ে নতুন নতুন ঢেউয়ে আছড়ে পড়ছে, তাতে বিশ্ব অর্থনীতির স্বাভাবিকতা ফিরে পেতে আরও কয়েক বছর লেগে যাবে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ থেকে শুরু করে অনেকেই তা বলছে। অর্থাৎ আমাদের আরও বেশ কিছুদিন এই পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করতে হবে।
এদিকে কোভিডের আগে থেকেই অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের নিম্নগামিতা লক্ষ করছি আমরা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এলডিসি উত্তরণের নতুন বাস্তবতা। তার সঙ্গে কোভিডের অভিঘাত। এতে দারিদ্র্য বেড়েছে, যদিও তার তাৎক্ষণিক তথ্য আমাদের হাতে নেই।
তবে সমস্যা বড়দের নয়, ছোটদের। বড়রা খারাপ নেই। বৈশ্বিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াতেও তা দেখা যাচ্ছে। যে কে–শেপড (কে আকৃতির) রিকভারির কথা অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, তার মূল কথা হলো এই প্রক্রিয়ায় বড় খাতগুলো দ্রুত প্রবৃদ্ধি করলেও অন্যরা তেমনটা করতে পারে না। অথচ এরাই সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান করে থাকে। তাই নজর দিতে হবে ছোটদের দিকে। ব্যাংকের অভিযোগ, এদের কাগজপত্র ঠিক নেই, তাই এরা প্রণোদনার ঋণ পাওয়ায় পিছিয়ে থাকে। ঠিক। তবে এটাই চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা গেলেই পুনরুদ্ধার টেকসই হবে।
কথা হচ্ছে, যাঁরা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁরা যেন পিছিয়ে না থাকেন, সেটা নিশ্চিত করাই এখন নীতি প্রণয়নের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।