একজন নারী প্রেগন্যান্সি টেস্ট করতে কিট ব্যবহার করে জানতে পারলেন তিনি প্রেগন্যান্ট। কয়েক মাস পর প্রেগন্যান্সির শারীরিক কোনো লক্ষণ তার মধ্যে না আসায় সন্দেহ হয় তার। আবারও তিনি টেস্ট করান। এবার তার অন্য প্রতিষ্ঠানের কিটে আসে নেগেটিভ। এরপর স্বামী-সংসারের কথা চিন্তা করে অসুস্থ হয়ে যান ওই নারী। জানা যায়, ওই নারী যে কিট ব্যবহার করে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করিয়েছিলেন সেটি ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ।
টেম্পারিং করে মেয়াদ বাড়িয়ে প্রেগন্যান্সিসহ করোনা ও জটিল অনেক রোগের কিটে বাজারে ছেয়ে গেছে তিনটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের কারণে। করোনা শনাক্তের কিট, রি-এজেন্ট জালিয়াতির মাধ্যমে নতুন করে মেয়াদ বাড়িয়ে ও নকল কিট বিক্রির অভিযোগে তিন প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে মূলহোতাসহ নয়জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রায় ৮ টন অনুমোদনহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নকল টেস্ট কিট, রি-এজেন্ট জব্দ করা হয়।
জালিয়াতির এসব কিটের মধ্যে প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিটসহ করোনা, ক্যানসার, এইডস, জন্ডিস, ডায়াবেটিস ও নিউমোনিয়া রোগের টেস্ট কিট ছিল। তারা মেয়াদ বাড়িয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করত বলে অভিযানে জানতে পারে র্যাব।
শুক্রবার (১৬ এপ্রিল) সাড়ে ৩টায় র্যাব-২-এর কার্যালয় বছিলায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-২-এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার।
তিনি বলেন, চক্রটি ২০১০ সাল থেকে একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে বিদেশ থেকে বিভিন্ন রোগের কিট এনে তা টেম্পারিং করে মেয়াদ বাড়াত। এই তিন প্রতিষ্ঠান প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিটসহ করোনা, ক্যানসার, এইডস, জন্ডিস, ডায়াবেটিস ও নিউমোনিয়া রোগের টেস্ট কিটের মেয়াদ বাড়িয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করত।
র্যাব-২-এর সিও লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার বলেন, র্যাব গোপন তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারে, কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠান অননুমোদিত মেডিকেল ডিভাইস আমদানিকরণ, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ করোনার টেস্টিং কিট ও রি-এজেন্টসহ অন্যান্য রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত বিভিন্ন রোগের টেস্টিং কিট ও রি-এজেন্ট মজুত ও বাজারজাত করে আসছে। এমন সংবাদের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের প্রতিনিধিদের সহযোগিতায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়া এলাকায় অবস্থিত বায়োল্যাব ইন্টারন্যাশনাল ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বনানী এলাকায় অবস্থিত এক্সন টেকনোলজি অ্যান্ড সার্ভিস লিমিটেড এবং হাইটেক হেলথকেয়ার লিমিটেড নামের তিনটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানো হয়।
অভিযানে দেখা যায়, ওই তিন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের উপস্থিতিতে বিশেষ ধরনের প্রিন্টিং মেশিনের সাহায্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ও মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার খুব অল্প সময় রয়েছে, এমন বিভিন্ন টেস্ট কিট ও রি-এজেন্টের মেয়াদ বাড়ানোর কাজ চলছে। পরবর্তীতে তাদের ওয়্যারহাউজগুলোতে তল্লাশির সময় বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। সেখানে মজুত বেশিরভাগ মেডিকেল ডিভাইস অননুমোদিত; প্রায় সকল প্রকার টেস্ট কিট এবং রি-এজেন্টের ব্যবহারের মেয়াদোত্তীর্ণ অথবা দ্রুতই মেয়াদোত্তীর্ণ হবে।
তিনি বলেন, এমনকি এইডস নির্ণয়ের জন্য নির্ধারিত প্যাথলজিক্যাল টেস্ট কিট ও রি-এজেন্টও রয়েছে এই তালিকায়, যা তাদের সংরক্ষণে মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থায় পাওয়া যায়।
জিজ্ঞাসাবাদে এই তিন প্রতিষ্ঠানের গ্রেফতাররা জানায়, ২০১০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো একাধিক নামে পারস্পরিক যোগসাজশে, অবৈধভাবে ও অসৎ পন্থায় আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে কোনো অনুমোদন ছাড়াই মানহীন ও স্বল্পমেয়াদী টেস্ট কিট ও রি-এজেন্ট বিদেশ থেকে আমদানি, সংরক্ষণ ও দেশব্যাপী বাজারজাতকরণ করত। যা সরবরাহ করার পর্যায়েই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যেত।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার বলেন, তারা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এই কিটগুলো সরবরাহ করত। তদন্তে প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম বের হয়ে আসবে। বিদেশ থেকে আমদানি-রফতানি চ্যানেলের মাধ্যমে তারা এসব সামগ্রী আনত। এছাড়া জার্মানি ও ইউরোপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকেও এসব সামগ্রী আনত। প্রতিষ্ঠানগুলো একটিও স্বনামধন্য নয়। তাদের এই কিট ও মেডিকেল সরঞ্জাম আমদানির কোনো অনুমোদনও ছিল না।
গ্রেফতাররা হলেন- বায়োল্যাব ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মো. শামীম মোল্লা (৪০), ব্যবস্থাপক মো. শহীদুল আলম (৪২), প্রধান প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল বাকী ছাব্বির (২৪), অফিস সহকারী মো. জিয়াউর রহমান (৩৫), হিসাবরক্ষক মো. সুমন (৩৫), অফিস ক্লার্ক ও মার্কেটিং অফিসার জাহিদুল আমিন পুলক (২৭), সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার মো. সোহেল রানা (২৮), এক্সন টেকনোলজিস্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের এমডি মো. মাহমুদুল হাসান (৪০), হাইটেক হেলথ কেয়ার লিমিটেডের এমডি এস এম মোজফা কামাল (৪৮)।