ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ। কিশোরগঞ্জ শহরের হারুয়া এলাকায় নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত। আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত মসজিদটি ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থাপনা হিসেবে পরিচিত। চমৎকার এর ইমারত আর নির্মাণশৈলী মন কাড়ে যে কারও। দৃষ্টিনন্দন এ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটি শুধুমাত্র মুসলমানদের কাছেই নয়, অন্যান্য ধর্মালম্বীদের কাছেও পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত।
আধুনিক নির্মাণ শৈলীতে নির্মিত হলেও প্রাচীন এ মসজিদটির প্রকৃত নির্মাণ সাল জানা যায়নি। তবে ঐতিহাসিকদের ধারণা অন্তত আড়াইশ বছর আগে এটি নির্মিত হয়েছিল। সংস্কারের পর তিনতলা বিশিষ্ট মসজিদটিতে একটি সউচ্চু মিনার রয়েছে। ৩ একর ৮৮ শতাংশ জমির উপর প্রতিষ্ঠিত মসজিদ ও ইসলামী কমপ্লেক্সটি ১৯৭৯ সালের ১০ মে থেকে পরিচালনা করছে ওয়াক্কফ প্রসাশন।
জনশ্রুতি রয়েছে, বার ভূঁইয়াদের অন্যতম ঈশাখাঁর শাসনামলের কোনো এক সময় সেই সময়কার খরস্রোতা নরসুন্দা নদীর মাঝখানে পাগলবেশী এক আধ্যাত্মিক ব্যক্তি মাদুর পেতে ভেসে এসে মসজিদের কাছে আশ্রয় নেন। পরে ওই পাগলের মৃত্যুর পর তার সমাধীর পাশে মসজিদটি গড়ে উঠে। পাগলের নামানুসারে এটির নাম হয় পাগলা মসজিদ।
আরেকটি জনশ্রুতি মতে, ঈশাখাঁর আমলে দেওয়ান জিলকদর খান ওরফে জিল কদর পাগলা নামে এক ব্যক্তি নদীর তীরে নামাজ পড়তেন। পরে স্থানটিতে মসজিদটি নির্মিত হয়। জিল কদর পাগলার নামানুসারে মসজিদটি ‘পাগলা মসজিদ’হিসেবে পরিচিতি পায়।
অপর জনশ্রুতি অনুসারে, কিশোরগঞ্জের হয়বতনগর জমিদার পরিবারের ‘পাগলা বিবি’র নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে।তবে এসবের কোনো সত্যতা জানা নেই কারও।
একটি আয়তাকার, বহুগম্বুজ বিশিষ্ট বিশাল আয়তনে ইট দিয়ে তৈরি এ মসজিদের দেয়ালের গায়ে টাইলসের আস্তরন রয়েছে। স্থানীয় উপকরণ দিয়ে মসজিদের নকশায় তুলে ধরা হয় নিজস্ব নির্মাণ শৈলী। আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত পাগলা মসজিদের মূল প্রার্থনা কক্ষসহ প্রতিটি কক্ষে আলো-বাতাস প্রবেশের পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে। মসজিদের ভেতরে দেশি-বিদেশি বিশাল ঝাড়বাতিতে সজ্জিত। তবে বর্তমানে নামাজের স্থানসহ বিভিন্ন কক্ষে শীতাতপ ও ভেতরে-বাইরে নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে।
মসজিদের সৌন্দর্য্য বর্ধনের পাশাপাশি নরসুন্দা নদী সংস্কার প্রকল্পে নদীর ঘাট ও মসজিদের সমানে দৃষ্টিনন্দন সেতু নির্মিত হয়েছে। মুসল্লিদের হাঁটার জন্য নির্মিত হয়েছে চারপাশে ওয়াকওয়ে। মসজিদের সু-উচ্চ মিনার দেখা যায় অনেক দূর থেকে। মিনারটিকে ঘিরেই স্থাপিত হয়েছে বৃত্তাকার আরও তিনটি ছোট মিনার। মিনারের তিনটি অংশ ভিত্তি, উপরে উঠানো ও গ্যালারি। মাটি খুঁড়ে শক্ত ভিত্তিতে নির্মিত মিনারটি বেলুনকার। মিরারের প্যাঁচানো সিড়ি কাঠামোকে আরও মজবুত করেছে। মিনারের শীর্ষভাগ মসজিদ থেকে অনেক উঁচু।
মসজিদের খরচে ২০০২ সালে মসজিদ ক্যাম্পাসে একটি হাফেজিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। পেছনে রয়েছে নিজস্ব কবরস্থান।
শুধু মুসলমানদের কাছেই নয়, সব ধর্মের মানুষের কাছে মসজিদটি পবিত্র হিসেবে পরিচিত। পাগলা মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে, এখানে মানুষ মন খুলে দান করেন। মানুষের বিশ্বাস সরল মনে পাগলা মসজিদে দান করলে যে কোনো বাসনা পূরণ হয়। মসজিদের বড় বড় আটটি লোহার সিন্দুকে নগদ টাকা, স্বর্ণসহ মূল্যবান জিনিস জমা পড়ে। তিন মাস পর পর এসব সিন্ধুক খুলে এক থেকে দেড়-দুই কোটি টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়।
দানের টাকায় মসজিদ কমপ্লেক্স ও মাদরাসার খরচ চালানো হয়। অতিরিক্ত টাকা ব্যাংকে জমা রাখা হয়। এ টাকা থেকে জেলার বিভিন্ন মসজিদ-মাদরাসায় অসুদান দেয়া হয়। এছাড়াও অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসায় মসজিদের তহবিল থেকে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়। মসজিদের পুরষের পাশাপাশি নারীদের জন্য আলাদা নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রশাসনের প্রত্যক্ষ তদারকিতে মসজিদটি পরিচালিত হচ্ছে। পদাধিকার বলে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি এবং পৌরসভার মেয়র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।