ম্যাচের প্রথম দুই দিন পরিষ্কারভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের চেয়ে এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ দল। আজ তৃতীয় দিন বিশেষ করে দিনের দ্বিতীয় সেশনে ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছিল সফরকারিরা।

হয়নি বাংলাদেশের দুর্দান্ত বোলিংয়ে। টাইগার স্পিনত্রয়ীর আক্রমণে মাত্র ৬ রানে শেষের ৫ উইকেট হারিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অলআউট হয়েছে ২৫৯ রানে। বাংলাদেশ তাতে পেয়েছে ১৭১ রানের বড় লিড।

তবে দ্বিতীয় ইনিংসে নেমেই বড় ধাক্কা খেয়েছে স্বাগতিকরাও। ১ রান তুলতেই হারিয়ে ফেলে ২ উইকেট। তৃতীয় দিন শেষে ২০ ওভারে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসের সংগ্রহ ৩ উইকেটে ৪৭ রান।

তবে বড় লিডের সুবাদে ঠিকই সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে গেছে টাইগাররা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের চেয়ে এখন ২১৮ রানে এগিয়ে বাংলাদেশ, হাতে ৭ উইকেট। চতুর্থ দিন লিড যত বাড়বে, ক্যারিবীয়দের দুশ্চিন্তাও তত বাড়বে।

কেমার রোচ জুজু কাটাতেই হয়তো টানা দ্বিতীয় ইনিংসে নিজে স্ট্রাইক না নিয়ে তামিম ইকবাল প্রথম বল খেলতে দিয়েছিলেন আরেক ওপেনার সাদমান ইসলামকে। কিন্তু এতে কোনো ফায়দা হয়নি তার। রোচের বল এড়িয়ে গেলেও বাঁহাতি এই ওপেনার আউট হয়েছেন রাহকিম কর্নওয়ালের বলে। একই ওভারে সাজঘরে ফিরেছেন নাজমুল হোসেন শান্তও।

এক ওভারে তামিম-শান্তর বিদায়ে দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম ২ ওভারে মাত্র ১ রানে দুই উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ দল। ফলে ক্যারিবীয়দের ২৫৯ রানে অলআউট করে ১৭১ রানের লিড পেলেও, দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুটা একদমই ভালো হয়নি টাইগারদের।

তামিমের টেস্ট ক্যারিয়ারের আগের ৬০ ম্যাচে কখনও এমন হয়নি যে, তিনি ইনিংস সূচনা করেছেন কিন্তু প্রথম বল মোকাবিলা করেননি। অথচ চলতি টেস্টের দুই ইনিংসেই তিনি স্ট্রাইক ছেড়ে দিয়েছেন সাদমানের কাছে। প্রতিপক্ষের পেসার কেমার রোচের বলে ওয়ানডে ৭ ও টেস্টে ৩ বার আউট হওয়ার কারণেই হয়তো এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তামিম।

একবারও সফল হননি তামিম। টেস্ট ক্যারিয়ারে চতুর্থবারের মতো আউট হন রোচের বলেই। পরে আজ দ্বিতীয় ইনিংসেও সাদমানকে স্ট্রাইক দেন তামিম। রোচের প্রথম ওভার পার করে দেন সাদমান। দ্বিতীয় ওভার আক্রমণে আসেন কর্নওয়াল। প্রথম তিন বল দেখেশুনে খেলে চতুর্থ বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েন তামিম। আগের ইনিংসে ৯ করলেও, এবার রানের খাতা খোলা সম্ভব হয়নি তার।

ইনিংসের শুরুতেই তামিমের বিদায়ের পর উইকেটে টিকতে পারেননি নাজমুল শান্তও। এক বল খুবই অলস এক শটে স্লিপে দাঁড়ানো জার্মেইন ব্ল্যাকউডের হাতে ধরা পড়েন তিনি। তামিম-নাজমুলের কেউই রানের খাতা খুলতে পারেননি। তৃতীয় উইকেট জুটিতে প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দেয়ার কাজে মন দেন অধিনায়ক মুমিনুল হক ও সাদমান।

রোচ-কর্নওয়ালদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের পর শ্যানন গ্যাব্রিয়েলের গোলায় বেশ অস্বস্তিতেই ভোগেন দুই টাইগার ব্যাটসম্যান। তবে নিজের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটতে দেননি ওপেনার সাদমান, মুখোমুখি প্রথম ২৭ বলে কোনো রানই নেননি তিনি। অন্যদিকে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে চাপ দূর করার চেষ্টায় ছিলেন মুমিনুল। সেখানে সফলও হন তিনি।

তাদের জুটিতে ১২.১ ওভারে আসে ৩১ রান। যখন মনে হচ্ছিল, হয়তো দিনের শেষভাগে আর উইকেট হারাবে না বাংলাদেশ, তখনই গ্যাব্রিয়েলের বাউন্সারে পরাস্ত হন সাদমান। লেগস্ট্যাম্পের ওপর থাকা বাউন্সারটি সাদমানের গ্লাভসে লেগে পেছন দিক দিয়ে চলে যায় উইকেটরক্ষক জশুয়া ডা সিলভার হাতে। সাদমান করেন ৪২ বলে ৫ রান।

তবে দলীয় ৩৩ রানে ৩ উইকেট হারানোর পর দলকে আর কোনো বিপদে পড়তে দেননি নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহীম ও মুমিনুল হক। দিনের বাকি ৩৫ বল নির্বিঘ্নে কাটিয়ে দেন তারা, স্কোরবোর্ডে যোগ করেন ১৪ রান। মুশফিক ১০ ও মুমিনুল ৩১ রানে অপরাজিত রয়েছেন।

২ উইকেটে ৭৫ রান নিয়ে আজকের দিনের খেলা শুরু করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এর সঙ্গে আর ১৮৩ রান যোগ করে অলআউট হয় তারা। দিনের প্রথম বলেই আগেরদিন সাবলীল ব্যাটিং করা এনক্রুমাহ বোনারকে স্লিপে দাঁড়ানো নাজমুল হোসেন শান্তর হাতে ক্যাচে পরিণত করেন তাইজুল। দিনের শুরুতেই আনন্দে ভাসে বাংলাদেশ দল।

সেই ওভারের চতুর্থ বলে কাইল মায়ারসের ব্যাটের কানায় লেগে সুযোগ আসে উইকেটরক্ষক লিটন দাসের কাছে। কিন্তু সেটি গ্লাভসবন্দী করতে পারেননি। তার কনুইয়ে লেগে বল চলে যায় স্লিপে দাঁড়ানো শান্তর কাছ দিয়ে। শুক্রবার ম্যাচের তৃতীয় দিনের প্রথম সেশনের পুরো চিত্রটাই যেন ফুঁটে ওঠে প্রথম ওভারের এই দুই বলে।

কেননা পুরো সেশনে বাংলাদেশ দল তিন উইকেট যেমন নিয়েছে, তেমনি অন্তত গোটা দুয়েক উইকেটের সুযোগও হাতছাড়া করেছে। তাইজুলের বলে লিটন দাসের ক্যাচ ছাড়ার পর নাঈম হাসানের বলে একটি রিভিউ নেয়নি বাংলাদেশ। এছাড়া ক্লোজ ইন ফিল্ড তথা শর্ট লেগ ও সিলি পয়েন্টেও ওঠে বেশ কিছু ক্যাচ। কিন্তু সেগুলো কাজে লাগাতে পারেনি টাইগাররা।

এদিকে কুঁচকির চোটের কারণে আজ মাঠে নামেননি সাকিব আল হাসান। তাকে ছাড়াই পুরোটা দিন খেলেছে বাংলাদেশ দল। তাইজুলের প্রথম বলেই পাওয়া উইকেট দিয়ে শুরু হয় সেশন। আগেরদিনে করা ১৭ রানেই আউট হন বোনার। পরে ক্যারিবীয় অধিনায়ক ক্রেইগ ব্রাথওয়েটকে দারুণ এক টার্নিং ডেলিভারিতে বোকা বানান নাইম।

এর আগেই ব্যক্তিগত ফিফটি তুলে নেন ব্রাথওয়েট, আউট হওয়ার আগে তার ব্যাট থেকে আসে ১১১ বলে ৭৬ রান। প্রথম সেশনের প্রথম বলে উইকেট হারালেও, ৩৩ ওভারে যে ১১৪ রান করতে পেরেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, এর বড় কৃতিত্ব পাবেন অভিষিক্ত কাইল মায়ারস।

চাপের মুখে ব্যাট করতে নেমে পাল্টা আক্রমণে রানের চাকা সচল রাখেন মায়ারস। মোস্তাফিজুর রহমানের ওভারে জোড়া চার দিয়ে শুরু করে নিয়মিতই বাউন্ডারি হাঁকাতে থাকেন মায়ারস। ক্যারিবীয়দের রানও বাড়তে থাকে তরতর করে।

ইনিংসের ৫০তম ওভারে আজ প্রথমবারের মতো আক্রমণে এসেই মায়ারসকে ফেরান মেহেদি হাসান মিরাজ। ওভারের শেষ বলে তার ভেতরে ঢোকা বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েন ৭টি চারের মারে ৬৫ বলে ৪০ রান করা অভিষিক্ত মায়ারস। এর আগে ব্রাথওয়েট আউট হওয়ার ওভারেই এজ হয়ে আসা বল চলে যায় লিটনের দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে, বেঁচে যান সেশন শেষে ৩৪ রানে অপরাজিত থাকা ব্ল্যাকউড।

এছাড়া একটি লেগ বিফোরের সিদ্ধান্তে রিভিউ নেয়নি বাংলাদেশ। রিপ্লেতে দেখা গেছে, সেই বলে আউট ছিলেন ব্যাটসম্যান। পরে মেহেদি মিরাজের বলে শর্ট লেগে দাঁড়ানো ইয়াসির রাব্বির হাতের কাছ দিয়ে চলে যায় একটি ক্যাচ। ইয়াসির রাব্বি আগেই উঠে দাঁড়ানোয় নাগাল পাননি সেই বলের। যার ফলে প্রথম সেশনে ৩ উইকেটের বেশি নিতে পারেনি বাংলাদেশ।

ম্যাচের সাত সেশন খেলা হওয়ার পর অবশেষে একটি সেশন নিজেদের করে নেয়ার পথে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। আজ ম্যাচের তৃতীয় দিনের দ্বিতীয় সেশনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদেরই হাতে। কিন্তু বিরতির ঠিক আগ দিয়ে জোড়া আঘাত করে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ।

পরে তৃতীয় সেশনের শুরুতে মাত্র ৩ ওভার বল করেই ক্যারিবীয়দের অলআউট করে দেয় টাইগাররা। সবমিলিয়ে মাত্র ৬ রানে শেষের ৫ উইকেট হারিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জার্মেইন ব্ল্যাকউড ও জশুয়া ডা সিলভার ইনিংস সর্বোচ্চ ৯৯ রানের ষষ্ঠ উইকেট জুটি ভাঙার পর মুখ থুবড়ে পড়ে ক্যারিবীয়দের ইনিংস।

ইনিংসের ৫১তম ওভারের প্রথম বল থেকে শুরু করে ৯৩তম ওভারের তৃতীয় বল পর্যন্ত একসঙ্গে উইকেটে ছিলেন ব্ল্যাকউড ও জশুয়া। এতে অবশ্য অবদান ছিল বাংলাদেশের ফিল্ডারদেরও। স্লিপে দাঁড়িয়ে ব্ল্যাকউডের সহজ ক্যাচ ছাড়েন নাজমুল হোসেন শান্ত, ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে একাধিক সুযোগ হাতছাড়া করেন ইয়াসির আলি রাব্বি।

দৃঢ় ব্যাটিংয়ের সঙ্গে ভাগ্যের সহায়তা পেয়ে ক্যারিবীয়দের ফলোঅন পার করায় ব্ল্যাকউড-জশুয়া জুটি। ব্ল্যাকউড তুলে নেন ক্যারিয়ারের ১৪তম টেস্ট ফিফটি। দ্বিতীয় সেশনে বাংলাদেশের বোলারদের হতাশ করে ৩০ ওভারে উইকেট না হারিয়ে ৬০ রান তুলে নেন এ দুজন।

সেশনের ৩১তম ওভারে জুটি ভাঙেন তাইজুল। তার অফস্ট্যাম্পের বাইরের নিচু হওয়া ডেলিভারি কাট করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ধরা পড়েন জশুয়া। ক্যারিবীয় এ উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান ১৪১ বল খেলে করেন ৪২ রান। পরের ওভারেই আরেক সেট ব্যাটসম্যান ব্ল্যাকউডকে ফেরান মেহেদি হাসান মিরাজ। লেগসাইড দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া বলে ব্যাট এগিয়ে দিয়ে কট বিহাইন্ড হন ৬৮ রান করা ব্ল্যাকউড।

এ দুই উইকেট তুলে নিয়ে চা পানের বিরতিতে যায় বাংলাদেশ। তৃতীয় সেশনে ফিরে মাত্র ১৮ বলের মধ্যেই বাকি ৩ উইকেট নিয়ে নেয় টাইগাররা। সেশনের তৃতীয় বলে কেমার রোচকে ফেরান মিরাজ। নিজের পরের ওভারের প্রথম বলে রাহকিম কর্নওয়ালকেও বোল্ড করেন তিনি।

এর পরের ওভারের প্রথম বলে জোমেল ওয়ারিকানকে বোল্ড করে ইনিংস মুড়িয়ে দেন তাইজুল। দ্বিতীয় সেশনের শেষ দিকে ৫ উইকেটে ২৫৩ থেকে তৃতীয় সেশনের শুরুতে ২৫৯ রানেই অলআউট হয়ে গেছে ক্যারিবীয়রা। ফলে বাংলাদেশের লিড দাঁড়ায় ১৭১ রানের।