লোহাগাড়া উপজেলা জাতীয় পার্টি নেতা ও ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনকে হত্যা করেছে তার খামারেরই দুই কর্মচারী। আর তার কারণ, বেতন দিতে দু’দিন দেরি। শুধু এই কারণেই মাথায় আঘাত করে হত্যার পর লাশ মাটিতে পুঁতে রেখে স্বজনদের সঙ্গে ‘নিখোঁজ’ আনোয়ারকে বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেছেও তারা। কিন্তু ঘটনার এক মাস পর একটি বিকাশ মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে পুলিশ ঘাতক দুই কর্মচারীকে গ্রেফতার করেছে। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী শুক্রবার রাতে লোহাগাড়া থানার দরবেশ হাট এলাকার আনোয়ারের গরুর খামারের পাশ থেকে অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার দুই কর্মচারীর একজন রোহিঙ্গা যুবক আনছার উদ্দিন ও অপরজন স্থানীয় বাসিন্দা মো. আসিফ। হত্যাকাণ্ডে আরও এক রোহিঙ্গা যুবক জড়িত। আনোয়ার উপজেলা জাতীয় পার্টির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন।
আনোয়ারের পরিবার ও পুলিশ সূত্র থেকে জানা যায়, ৩০ ডিসেম্বর বিকালে লোহাগাড়ার দরবেশহাট সওদাগর পাড়ায় নিজস্ব খামারে যান আনোয়ার। রাত ৮টায় বটতলী ফোরকান টাওয়ারের বাসায় ফেরার পথে তিনি নিখোঁজ হন। সেই থেকে বন্ধ পাওয়া যায় তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও। পরদিন ৩১ ডিসেম্বর সকালে আনোয়ার হোসেনের ছোটভাই মো. সেলিম লোহাগাড়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তাছাড়া নিখোঁজের পর স্বজনরা আনোয়ারকে খুঁজতে থাকেন। তাদের সঙ্গে খামারের দুই কর্মচারীও আনোয়ারকে খোঁজেন নানা জায়গায়। সাধারণ ডায়েরি করার পর ঘটনা তদন্তে মাঠে নামে পুলিশ। হঠাৎ একদিন আনোয়ারের মোবাইল নম্বর থেকে ফোন করে তার (আনোয়ারের) ভাই সেলিমের কাছে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এক লাখ ৩০ হাজার টাকায় বনিবনা হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর নম্বরটি বন্ধ হয়ে যায়। বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করলেও তারা ফোনের উৎস খুঁজে পায়নি।
আনোয়ারের পরিবারের সদস্যরা আরও জানিয়েছেন, ১ জানুয়ারি আনছার উদ্দিনসহ দুই কর্মচারী কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে যায়। তাদের মোবাইল ফোনও বন্ধ করে দেয়। এ অবস্থায় আনোয়ারের দুই রোহিঙ্গা কর্মচারী আনছার ও মাহবুবকে সন্দেহের তালিকায় আনে পুলিশ। কিন্তু সুনির্দিষ্ট ঠিকানা না থাকায় দুই রোহিঙ্গা যুবককে আটক করা যাচ্ছিল না। তদন্তকালে পুলিশ জানতে পারে, এক মাস আগে আনছার উদ্দিন টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্ত্রীর কাছে একটি বিকাশ নম্বরে ১০ হাজার টাকা পাঠিয়েছিল। পুলিশ একটি বিকাশের দোকান থেকে ওই নম্বরটি জোগাড় করে। পুলিশ মোবাইল নম্বরটিকে ট্রেস করে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে নিশ্চিত হয় এটি কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে ব্যবহার হচ্ছে। লোহাগাড়া থানার এসআই পার্থ সারথি হাওলাদারের নেতৃত্বে একটি টিম গিয়ে রোহিঙ্গা কুতুপালং ক্যাম্প থেকে আনোয়ারের খামারের কর্মচারী আনছার উদ্দিনকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে। তাকে দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। একপর্যায়ে সর্বশেষ শুক্রবার রাতে পুলিশের কাছে আনছার উদ্দিন স্বীকার করে, ‘আনোয়ার হোসেনকে হত্যা করে লাশ গরুর খামারের পাশে গর্ত করে পুঁতে রাখা হয়েছে।’
ঘাতক আনছার উদ্দিনের পুলিশকে দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ৩০ ডিসেম্বর রাতে আনোয়ারের কাছে বেতন চায়। টাকা দিতে দু-এক দিন দেরি হবে বললে তারা ক্ষিপ্ত হয়। ওই রাতেই তারা দু’জন আনোয়ার ও মাহবুব প্রথমে আনোয়ারকে কোদাল দিয়ে মাথায় আঘাত করে। এতে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে তাকে ছুরি দিয়ে জবাই করা হয়। পরে তারা খামারের পাশে লাশ মাটি চাপা দেয়। এর আগে আনোয়ারের শার্টের পকেট থেকে ১৬ হাজার টাকা নিয়ে নেয়। তারা দু’জনে ভাগ করে ৮ হাজার টাকা করে নেয়। নিহতের পরিবারের অভিযোগ, আনোয়ারের পকেটে ২ লাখ টাকার বেশি ছিল।
শুক্রবার (২৯ জানুয়ারি) রাতে আনছার উদ্দিন ঘটনা স্বীকার করলে লোহাগাড়া পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে জেলা পুলিশ সুপার এসএম রশিদুল হক ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাতকানিয়া সার্কেল) জাকারিয়া রহমান জিকুসহ জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানানো হয়। এরপর গভীর রাতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাতকানিয়া সার্কেল) জাকারিয়া রাহমান জিকুর নেতৃত্বাধীন পুলিশের টিম ঘাতক আনছার উদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে আনোয়ারের গরুর খামারে যায়। ঘাতক আনছারের দেখানো মতে আনোয়ারের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পোস্টমর্টেম করা হয়। লোহাগাড়া থানার ওসি জাকির হোসেন মাহমুদ ও পরিদর্শক (তদন্ত) রাশিদুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।