প্রতিশ্রুতি মিলেছে বারবার। কিন্তু দিন-মাস পেরিয়ে বছর যায়, সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখে না মানুষ। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও চেত্রার বুকে হয়নি বহুল কাঙ্ক্ষিত সেতু। আর তাই জনপ্রতিনিধিদের ওপর অনেকটা অভিমান করেই প্রায় সাতশ ফুট দৈর্ঘ্যের সাঁকো বানিয়ে যাতায়াত করছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার অরুয়াইল ও পাকশিমুল ইউনিয়নের বাসিন্দারা।

প্রায় ২০ বছর আগে অরুয়াইল ইউনিয়নের রানিদিয়া গ্রামের লোকজন নিজেদের অর্থে বিশাল এই সাঁকো তৈরি করেন। কিন্তু আজও চেত্রার বুকে সেতুর জন্য হাহাকার থামেনি অরুয়াইল ও পাকশিমুল ইউনিয়নের বাসিন্দাদের।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অরুয়াইল ইউনিয়নকে দুইভাগে বিভক্ত করেছে চেত্রা নদী। এই নদীর উত্তরপাশে অরুয়াইল বাজারের অবস্থান। অরুয়াইল ইউনিয়নের বাসিন্দাদের পাশাপাশি পাকশিমুল ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারাও অরুয়াইল বাজারটি ব্যবহার করেন।

এছাড়া স্কুল-কলেজ ও ব্যাংক-বীমা সবকিছুই অরুয়াইল বাজার ও আশপাশ এলাকায়। ফলে দুই ইউনিয়নের অন্তত ২০ গ্রামের মানুষকে চেত্রা পাড়ি দিয়ে অরুয়াইল বাজারে আসতে হয় প্রয়োজনীয় কাজ সারতে।

অরুয়াইল ইউনিয়নের অরুয়াইল, রানিদিয়া, কাকুরিয়া, চরকাকুরিয়া, রাজাপুর, বুনিয়ারটেক, ধামাউড়া, দুবাজাইল, সিঙ্গাপুর ও পাকশিমুল ইউনিয়নের পাকশিমুল, ফতেহপুর, পরমান্দপুর, হরিপুর, ষাটবাড়িয়া এবং বড়ইছাড়াসহ অন্তত ২০ গ্রামের মানুষ এই সাঁকো ব্যবহার করেন। এছাড়া অরুয়াইল ও পাকশিমুল ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব ও বাজিতপুর উপজেলার কয়েকটি গ্রামের মানুষও ব্যবহার করেন এই সাঁকো।

স্বাধীনতার পর থেকেই চেত্রা নদী পারাপারে নৌকা ব্যবহার করেন অরুয়াইল ও পাকশিমুল ইউনিয়নের বাসিন্দারা। কিন্তু নৌকায় নদী পাড়ি দিতে গিয়ে বিভিন্ন সময় দুর্ঘাটনা ঘটে। এর ফলে স্থানীয়রা চেত্রা নদীতে একটি সেতু করে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছেন। জনপ্রতিনিধিরা সেতু করে দেয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন বারবার। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও হয়নি সেই সেতু।

শেষমেশ আশায় আশায় বসে না থেকে প্রায় ২০ বছর আগে রানিদিয়া গ্রামের বাসিন্দারা মিলে চেত্রা নদীতে সাতশত ফুট দৈর্ঘ্যের একটি সাঁকো বানান। এই সাঁকো পারাপারের জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে দুই টাকা করে নেয়া হয়।

মানুষের পাশপাশি ভারী মালামাল বহন এবং মোটরসাইকেলও পার করা হয় এই বাঁশের সাঁকো দিয়ে। এর ফলে প্রতিবছরই সাঁকোটি মেরামত করতে হয়। এছাড়া সাঁকো পারাপারের সময় প্রায়ই ছোট-খাটো দুর্ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে ছোট শিশু, স্কুল শিক্ষার্থী, গর্ভবতী নারী ও বয়োজ্যেষ্ঠরা সাঁকো পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন।

আলফাজ উদ্দিন নামে এক বৃদ্ধ জানান, স্বাধীনতার পর থেকেই চেত্রা নদীর ওপর সেতু বানিয়ে দেয়ার জন্য দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। নির্বাচন এলেই এমপি-চেয়ারম্যানরা বলেন সেতু করে দেবেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেতুর কোনো হদিস নেই। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় রাস্তা-ঘাট ও সেতু হয়েছে, অথচ এখনও সেতুর অভাবে বাঁশের সাঁকো দিয়ে নদী পার হতে হয় চেত্রার দুই পাড়ের মানুষজনদের।

অরুয়াইল ইউনিয়নের রানিদীয়া গ্রামের বাসিন্দা আমান উল্লাহ জানান, সেতু না থাকার কারণে মাথায় করে মালামাল নিয়ে সাঁকো পার হতে হয়। যদি সেতু থাকত তাহলে আর কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকত না। দ্রুত একটি সেতু করে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।

বৃষ্টি রাণী দাস নামে এক স্কুল শিক্ষার্থী জানায়, সে অরুয়াইল বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। প্রতিদিন এই বাঁশের সাঁকো দিয়েই তাকে নদী পার হয়ে স্কুলে যেতে হয়। সাঁকো পার হতে গিয়ে তাদের বই-খাতা নদীতে পড়ে যায়। সাঁকোটি সরু হওয়ায় অনেক সময় ছোট শিক্ষার্থীরা নদীতে পড়ে যায়। তাই দ্রুত একটি সেতু করার জন্য দাবি জানায় সে।

স্থানীয় সমাজকর্মী মনসুর আলী জানান, স্বাধীনতার পর থেকেই চেত্রা নদীর ওপর সেতু হবে-হচ্ছে বলে আশায় বুক বেঁধে আছেন দুই ইউনিয়নের লাখো মানুষ। সেতুর অভাবে মানুষজন অনেক কষ্ট করে নদী পার হয়। অনেক সময়ই দুর্ঘটনা ঘটে। মাঝে-মধ্যে যখন এই সাঁকো ভেঙে পড়ে তখন মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়ে যায়। মানুষের এই দুর্ভোগ লাঘবে অনতিবিলম্বে একটি সেতু করা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।

অরুয়াইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, অরুয়াইল ও পাকশিমুল ইউনিয়নের মানুষের দুঃখ দূর করতে চেত্রা নদীর ওপর সেতু করার জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে আমরা বারবার যোগাযোগ করছি। কিন্তু কেউই এ বিষয়ে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের সরাইল উপজেলা প্রকৌশলী নিলুফা ইয়াছমিন বলেন, চেত্রা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠিয়েছি। প্রয়োজনীয় অনুমোদন মেলার পরই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে। তবে এই অনুমোদন কবে মিলবে সেটি নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।