বগুড়ার সোনাতলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি নাজির আখতার কলেজ। ১৯৬৭ সালে ১৯ বিঘা জায়গার ওপর কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতে ‘সোনাতলা কলেজ’ নাম ছিল এর। শিক্ষানুরাগী ও দানবীর সৈয়দ নূরুল হুদা নিজের কবরের জন্য ১ শতক জায়গা রেখে তার পৈতৃক বসতবাড়ির পুরোটাই কলেজের জন্য দান করে দেন।

তার ভাই সৈয়দ নজমুল হুদাও কলেজটিতে জমি দান করেন। তাদের বাবা সৈয়দ নাজির আলী এবং মা আখতারুন্নেছার নামানুসারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয় ‘সোনাতলা নাজির আখতার কলেজ’। ১৯৮৪ সালে কলেজটি সরকারি হয়। এখন উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক ছাড়াও ৬টি বিষয়ে এখানে স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয়।

আর এই কলেজ চত্বরেই দাঁড়িয়ে আছে বিরল গাছ পারুল। বিরল বলছি এই কারণেই যে সুদূর অতীতে উপমহাদেশে দু-একটি পারুল গাছ থাকলেও তা আজ বিলীন। প্রায় ৪০-৫০ ফুট উঁচু গুল্ম জাতীয় এ গাছটি সারাদেশেই বিরল বলে জানিয়েছেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও বৃক্ষ গবেষকগণ। গাছটির পৃষ্ঠদেশ কিছুটা ধূসর কালচে ধরনের। পাতার রং গাঢ় সবুজ।

পাতার আকার ৬ থেকে ৭ ইঞ্চি। শীতকালে গাছটির পাতা ঝরে যায়। এপ্রিল মাসে পুষ্প-পল্লবে সুশোভিত হয়ে ওঠে গাছটি। এ সময় পুরো গাছে পাতার ফাঁকে-ফাঁকে অজস্র সাদা সাদা ফুল ফোটে। সাদা ফুলগুলোর দৈর্ঘ্য ১ ইঞ্চির মতো। গাছটিতে প্রায় ১০ ইঞ্চির মতো চিকন বাঁকানো ফল হয়। ফলগুলো শুষ্ক হয়ে ঝরে পরে। ফুলগুলোর তেমন গন্ধ অনুভূত না হলেও তাতে অজস্র ভ্রমরের গুঞ্জনে কলেজ চত্বরে অভাবনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

ফুল ফোটা অবস্থায় গাছটি পর্যবেক্ষণ করেছেন বৃক্ষপ্রেমী ও গবেষক, যশোর শিক্ষাবোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর আমিরুল আলম খান। তিনি পরীক্ষার জন্য গাছটির পাতা, ফুল ও ফল ঢাকায় নিয়ে গিয়েছেন। বৃক্ষ নিয়ে সারাদেশ চষে বেড়ানো প্রফেসর আমিরুল আলম খানের ভাষ্য, ‘এটি বাংলাদেশের একটি বিরল প্রজাতির গাছ।

গাছটি মূল পারুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা গাছটির পাতা, ফুল ও ফল নিয়ে গবেষণা করছেন। তবে এ গাছটি বাংলাদেশের একমাত্র বিরল প্রজাতির গাছ তাতে কোন সন্দেহ নেই। টিস্যু কালচারের মাধ্যমে গাছটির বংশবৃদ্ধি করা দরকার’।

তিনি পারুল নিয়ে ‘পারুলের সন্ধানে’ নামক একটি গ্রন্থও লিখেছেন’। তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘সারা বাংলাদেশে মূল পারুল না পেয়ে তিনি চলে যান পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে। উদ্দেশ্য, যেহেতু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পারুল নিয়ে অনেক গান ও কবিতা লিখেছেন তাই তারই হাতে গড়া দুষ্প্রাপ্য বৃক্ষতে ভরা শান্তিনিকেতনে যদি পারুলের সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি তার বইয়ে লিখেছেন, শান্তিনিকেতনের উদ্যান আধিকারিক তাকে জানান, তারা নাকি আসমুদ্র হিমাচল চষে বেড়িয়েছেন পারুলের সন্ধানে। এ শূন্যতা পূরণে শান্তিনিকেতনের কাছাকাছি পারুলডাঙ্গায় অনুসন্ধান চালান তারা।

তাদের ধারণা, জায়গার নাম পারুলডাঙ্গা তাই সেখানে গেলে নিশ্চয়ই পারুলের খোঁজ পাওয়া যাবে। অনেক অনুসন্ধান করেও তারা হতাশ হন। এমনকি বাংলা-ইংরেজি পত্রিকায় এ নিয়ে বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হয়। তাতে কেউ পারুলের অনুসন্ধান দিতে পারলে তার জন্য বড় ধরণের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়’।

গাছটি নিয়ে আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক ও নিরলে বিরলে পারুল গ্রন্ত্রের প্রণেতা প্রভাষক ইকবাল কবির লেমন জানান, নাজির আখতার কলেজের জমিদাতা মরহুম সৈয়দ নুরুল হুদা তার কর্মস্থল অবিভক্ত ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার খরগপুর থেকে বিরল প্রজাতির দুটি চারা এনে তার তৎকালীন বসতভিটায় রোপণ করেন। চারা দুটির একটি মরে গেলেও অপর চারাটি আজকের এই বৃহৎ বৃক্ষে রূপ নিয়েছে।

স্থানীয়ভাবে সকলেই গাছটিকে পারুল বলে ডাকলেও কেউ জানতোনা গাছটির মাহাত্ম। এ গাছটি যে, সারাদেশের একমাত্র বিরল গাছ সে বিষয়েও কেউ অবগত ছিল না। বিভিন্ন সময়ে এই গাছ নিয়ে বরেণ্য বৃক্ষবিশারদরা আসতো গবেষণা করতে।

২০১৫ সালে যশোর শিক্ষাবোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর আমিরুল আলম খান দেখতে এলেন সোনাতলার বিরল পারুল গাছ। এর কিছুদিনের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. অপুর্ব কুমার রায় সোনাতলায় পারুল গাছ দেখতে আসেন।

পারুল গবেষক এই দুই গুণী ব্যক্তির সান্নিধ্য এবং পারুল নিয়ে তাদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে পারুল নিয়ে কিছু করতে উৎসাহ যোগায়। পারুল নিয়ে বাড়তে থাকলো আমার আগ্রহ। সোনাতলায় নিরলে পড়ে থাকা বিরল পারুল বিষয়ে সকলকে জানাতে ২০১৭ সালে অমর একুশে বইমেলায় ‘নিরলে বিরলে পারুল’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করি’।

সত্তর দশকে দৈনিক সংবাদে ফুল বিষয়ক একটি লেখায় প্রকৃতিপ্রেমী ওয়াহিদুল হকের একটি লেখায় তিনি ‘কোথায় গেল পারুল’ বলে মন্তব্য করেন।

উল্লেখ্য, বিভিন্ন লেখায় পারুলের বর্ণনায় এসেছে, পারুল ‘Bignoniceae’ পরিবারভুক্ত। বর্তমান বৈজ্ঞানিক নাম ‘Stereospermum cheloniodes’ পূর্বের বৈজ্ঞানিক নাম ‘Stereospermum suaveolens’। ইংরেজি নাম ‘Trumpet’। পারুলের আদি নাম পাটল। পাটল একটি রঙের নাম। পাটল থেকে পাড়ল-পারল-পারউল-পারুল এ পরিবর্তীত হয়েছে।

পারুল পরিবারের বিভিন্ন রকম ফুলের অস্তিত্ব রয়েছে বলে বৃক্ষ গবেষকদের অভিমত। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রক্ত পারুল, পিত পারুল, ঘণ্টা পারুল ও লতা পারুল। উপরোক্ত পারুলগুলো কিছুটা দৃশ্যমান হলেও মূল পারুল কিন্তু এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

এমনি অবস্থায় বৃক্ষ প্রেমিক ও গবেষকদের দৃষ্টি পড়ে সোনাতলা সরকারি নাজির আখতার কলেজের পারুল নামের গাছটির প্রতি। ইতোমধ্যেই গাছটি পর্যবেক্ষণ করে গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর আবুল হাসান।

জানা যায়, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এ গাছতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের দু-একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরবর্তী সময় কলেজ কেন্দ্রীক ছাত্র রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক চর্চার একটি বড় মাধ্যম হয়ে ওঠে গাছ তলাটি।