বহু প্রতিক্ষা, অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসন ঘটিয়ে অবশেষে দৃশ্যমান হলো বহুল প্রতিক্ষীত ১৮ কোটি জনগনের স্বপ্ন।

দেশের ১৮ কোটি জনগনের অর্থয়ানে ৪১তম স্প‌্যান সংযোজনের মাধ্যমে উত্তাল পদ্মার বুক ফুঁড়ে মাথা তুলে দাঁড়ালো পদ্মা সেতু। বহুদিনের অপেক্ষার পর  সংযুক্ত হলো পদ্মার এপাড়-ওপাড়, মুন্সিগঞ্জের মাওয়া থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা।

পদ্মা নদীতে এখন দৃশ্যমান পদ্মাসেতুর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু।

বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) সকালে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয়েছে ৪১তম, অর্থাৎ সর্বশেষ স্প্যানটি। ৪০তম স্প্যান বসানোর ৬ দিনের মাথায় বসানো হলো এ স্প্যান। ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি স্প্যান বসানোয় ৬ হাজার ১৫০ মিটার সেতুর অবকাঠামো দৃশ্যমান হলো।

গেল ২ মাসে সেতুতে ৮টি স্প্যান বসিয়ে রেকর্ড গড়েছেন দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীরা। এ মাসেও ২টি স্প্যান স্থাপন করার মাধ্যমে বিজয়ের মাসে স্প্যান বসানোর কাজটি সম্পন্ন হলো।

সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর ৪১তম স্প্যান ‘টু-এফ’ সফলভাবে স্থাপন করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প ব্যবস্থাপক (মূল সেতু) দেওয়ান আবদুল কাদের।

এর আগে বুধবার বিকেল ৫টার দিকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে ‘তিয়ান-ই’ নামের ভাসমান ক্রেনটি ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের স্প্যানটিকে বহন করে রওনা দেয়। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের কাছে পৌঁছায় স্প্যানবহনকারী ক্রেনটি। এরপর নোঙর করার কাজটিও সম্পন্ন করে রাখা হয়েছিল। আর কোনো নৌযান যাতে বাধা তৈরি না করে এর জন্য সেনাবাহিনীর সদস্যরা বুধবার থেকে সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন।

পদ্মা সেতুর প্রকৌশলী সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ২ পিলারের মধ্যবর্তী স্থানে স্প্যান বহনকারী ভাসমান ক্রেনটি পজিশনিং করে। এরপর স্প্যানটিকে ইঞ্চি ইঞ্চি মেপে তোলা হয় পিলারের উচ্চতায়। তারপর রাখা হয় ২টি পিলারের বেয়ারিংয়ের ওপর। স্প্যানটি বসানোর জন্য ধাপগুলো সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ায় প্রকৌশলীদের বেগ পেতে হয়নি। কোনো রকম বাধা ছাড়াই স্প্যানটি বসানোর মাধ্যমে খুশি সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে। এরপর প্রথম স্প্যান বসানো হয়েছিল ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এরপর নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে ধাপে ধাপে স্প্যান বসতে থাকে। আমাজান নদীর পরই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি খরস্রোতা ও প্রমত্তা নদী পদ্মার বুকে দাঁড়িয়েছে পিলার। যাতে বসানো হয় স্প্যানগুলো।

এদিকে, ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের শেষ স্প্যানটি বসানোয় বিজয়ের মাসে পদ্মা জয় করলো পদ্মা সেতু। এখন নদীর ওপর দেখা যাচ্ছে ৬ হাজার ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের অবকাঠামো। সেতুর কাজে নিয়োজিত দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী, শ্রমিকরাও শেষ স্প্যান বসিয়ে আনন্দিত। চলতি বছর করোনা পরিস্থিতি ও বন্যার কারণে ৪ মাস স্প্যান বসানো হয়নি। পদ্মাপাড়ের সবার চোখে মুখে এখন আনন্দের হাসি।

জানা যায়, পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রয়োজন হচ্ছে ২ হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাব। এর মধ্যে নভেম্বর পর্যন্ত বসানো হয়েছে ১ হাজার ২৩৯টির বেশি স্ল্যাব। এ ছাড়া ২ হাজার ৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো হবে। এ পর্যন্ত বসানো হয়েছে ১ হাজার ৮৬০টির বেশি স্ল্যাব।

৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতুর কাঠামো। সেতুর ওপরের অংশে যানবাহন ও নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন।

২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে স্প্যান বসানোর কাজ শুরু করে ১২ ও ১৩ নম্বরে ৪১তম স্প্যানের মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হলো পদ্মা সেতু।