এই আম হিমসাগর নামেও পরিচিত।
দেশের তৃতীয় ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে এবার নিবন্ধন পেল সুমিষ্ট আমের রাজধানী খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের ‘খিরসাপাত’ আম। আজ রোববার সকালে শিল্প মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ন এই সনদ প্রদান করেন।
সনদপত্র গ্রহণ করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতাধীন উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের(গাজীপুর) পরিচালক ড. মোদন গোপাল সাহা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শফিকুল ইসলাম।
ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে আমের রাজ্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আমের অনুকূলে নিবন্ধন সনদ প্রদান করেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)।
এদিকে, জিআই পণ্য হিসেবে ‘খিরসাপাত আম’ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়ায় এবং এ খবর ছড়িয়ে পড়ায় আনন্দিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আমচাষী ও ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘খিরসাপাত’ নামের পরিচিতির পাশাপাশি এখন বিশ্ববাজারে এই আম রপ্তানি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন এ অঞ্চলের আমচাষী ও ব্যবসায়ীরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শফিকুল ইসলাম জানান, জিআই সনদ পাওয়ার মধ্য দিয়ে ব্র্যান্ডিং হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আমের। পরবর্তীতে এই পরিচিতি দিয়ে মেধাসত্ত্ব পাওয়া যাবে। এতে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে লাভবান হবে জেলার খিরসাপাত আম।
শফিকুল আরও বলেন, এখন থেকে এই আম অন্য নামে কেউ বাজারজাত করতে পারবে না এবং ক্রেতারাও প্রতারিত হবেন না। বাণিজ্যিক ও আরও মানসম্মতভাবে এই আমের উৎপাদন বাড়াতে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ এবং চাষিদের মাঝে সদনপত্র দেওয়া হবে।
কেবল চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ৩ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে প্রতিবছর ৩৫ হাজার টন খিরসাপাত আম উৎপদন হয় বলেও জানান শফিকুল ইসলাম।
আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জে আড়ই’শ জাতের আমের মধ্যে সবচেয়ে সুস্বাদু ও জনপ্রিয় জাত হচ্ছে এই ‘খিরসাপাত’। জেলার বাইরে এই আম হিমসাগর নামেও পরিচিত। মাঝারি আকারের এবং অনেকটা ডিম্বাকৃতির এই আম লম্বায় গড়ে ৮ দশমিক ৬ সেন্টিমিটার এবং ওজন হয় আড়াইশো গ্রাম থেকে সাড়ে তিনশো গ্রাম। পাকা আমের ত্বকের রঙ সামান্য হলদে এবং শাসের রঙ হলুদাভ। শাস-আঁশবিহীন, রসাল ও আকর্ষণীয় গন্ধযুক্ত এবং গড় মিষ্টতা ২৩ শতাংশ।
বাণিজ্যিকভাবে চাষ হওয়া সুস্বাদু জাতের এই আম দেশের চাহিদা মিটিয়ে গত চার বছর ধরে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও হচ্ছে। তাই আমচাষী, বাগানমালিক, আমব্যবসায়ী ও সংগঠনগুলো ‘খিরসাপাত আম’ কে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির দাবী করে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে।
অবশেষে এই আমের স্বত্ব সুরক্ষার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও আঞ্চলিক উদ্যাণতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র। এরই অংশ হিসেবে ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ‘খিরসাপাত, ল্যাংড়া ও আশ্বিণা আমকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের আবেদন করা হয়। আর এই তিন জাতের আমের মধ্যে ‘খিরসাপাত’ আমকেই জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর।
শুরুটা প্রায় ২০০ বছর আগে। ময়মনসিংহের মহারাজা সুতাংশু কুমার আচার্য্য বাহাদুর চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গড়ে তোলেন একটি আমবাগান। সেই বাগানইে অন্যান্য উৎকৃষ্ট জাতের আমের সঙ্গে চাষ হতো খিরসাপাত আম। এ ছাড়া ১৯৫৫ সালে স্থানীয় লোকসংগীত আলকাপ গানের বন্দনা ছড়ায় উল্লেখ রয়েছে খিরসাপাত আমের কথা। বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পাঁচটি উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে সুস্বাদু এই জাতটি।
লোক সংস্কৃতির গবেষক অধ্যাপক ড. মাজহারুল ইসলাম তুর বলেন, প্রাচীন লোক সংস্কৃতি ‘আলকাপ’ গানের ছড়ায় আড়াইশো জাতের আমের মধ্যে এই ‘খিরসাপাত’ আমের নাম রয়েছে। এ ছাড়া জেলার গেজেট অনুসন্ধানেও এই খিরসাপাত আমকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বলেও উল্লেখ করা হয়।
কানসাট আম আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক বলেন, এর ফলে দেশের বাজারে এই আমের চাহিদা যেমন বাড়বে, তেমনি আর্ন্তজাতিক বাজারে রপ্তানির আরও বেশি সুযোগ তৈরি হবে। পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবেও এই আমের উৎপাদন আরও বাড়বে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. মঞ্জুরুল হুদা জানান, ‘খিরসাপাত আম জিআই সদন পাওয়ায় এখন থেকে বাজারজাতের সময় আমের গায়ে ট্যাগ লাগানো থাকবে। ক্রেতারাও আমটি চিনতে পারবে। এতে অন্য আম আর বাজারে চালিয়ে দিতে পারবে না। চাষিরাও মূল্য পাবেন। এভাবে খিরসাপাত আমের একটি ব্র্যান্ডিং হবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে দেশের আমের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ হবে।
অন্যদিকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে জেলা প্রশসক (ডিসি) এ জেড এম নুরুল হক জানান, খিরসাপাত আম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় এ আমের বাণিজ্যিক উৎপাদন ও সম্প্রসারণ এবং দেশের অভ্যন্তরীণ ও আর্ন্তজাতিক বাজারে রপ্তানির বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে। এটি অনেক দিনের চাওয়া ছিলো জেলাবাসীর। এর ফলে জেলার উন্নয়নে এটি মাইলফলক হবে।
বর্তমানে দেশের উৎপাদিত আমের ৩০ শতাংশই খিরসাপাত আম। আর জিআই স্বৃকীতির মাধ্যমে এখন থেকে এই আম বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবেও স্বীকৃতি পাবে।