এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কুরআনুল কারিম এক জীবন্ত বিশ্বকোষ। এতে রয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞান সমাহার। অতিত ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিধি-বিধান থেকে শুরু করে বাদ যায়নি উদ্ভিদ, ফল, তরু-লতা ও গাছ-গাছালির বিবরণ। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক। আমিই প্রচুর বারি বর্ষণ করি। পরে আমি ভূমি প্রকৃষ্টরূপে বিদীর্ণ করি এবং আমি তাতে উৎপন্ন করি শস্য, আঙুর, শাক-সবজি, জাইতুন, খেজুর, বহু বৃক্ষবিশিষ্ট বাগান, ফল ও গবাদি খাদ্য। এটা তোমাদের ও তোমাদের জীবজন্তুর ভোগের জন্য।’ (সুরা আবাসা : আয়াত ২৪-৩২)
প্রাকৃতিক বৈচিত্রের নয়নাভিরাম সাদৃশ্য ও কুদরতের কথা মানুষের সামনে তুলে ধরতে আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে বলেন-
‘যিনি তোমাদের জন্য তা (পানি) দিয়ে শস্য, জাইতুন, খেজুরগাছ, আঙুর ও সব ধরনের ফল ফলান। অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’ (সুরা নাহল : আয়াত ১১)
এছাড়াও কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন উদ্ভিদের নাম ও শ্রেণি উল্লেখ করেছেন। কয়েকটি সুরার নামকরণও করা হয়েছে উদ্ভিদের নামে। আবার কোনো কিছুর প্রমাণস্বরূপ কিংবা সাধারণ বর্ণনা হিসেবে এসেছে উদ্ভিদের নাম। যার কিছু তুলে ধরা হলো-
>> মান্না
এক প্রকার খাদ্য, যা আল্লাহ তা‘আলা বনি ইসরাইলের জন্য আসমান থেকে অবতীর্ণ করতেন। তা ছিল দুধের চেয়েও সাদা এবং মধুর চেয়েও মিষ্টি। এটি দিয়ে মানুষের রুটির অভাব মিটতো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ‘الْكَمْأَةُ مِنَ الْمَنِّ ‘কামআহ হ’ল মান্ন-এর অন্তর্ভুক্ত’। (তিরমিজি, মিশকাত)
আধুনিক গবেষণায় বলা হয় যে, মান্ন একপ্রকার আঠা জাতীয় উপাদেয় খাদ্য। যা শুকিয়ে পিষে রুটি তৈরী করে তৃপ্তির সাথে আহার করা যায়। দক্ষিণ ইউরোপের সিসিলিতে, আরব উপদ্বীপের ইরাকে ও ইরানে, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতবর্ষে মান্না জাতীয় খাদ্য উৎপন্ন হয়।’ (ডঃ ইকতেদার হোসেন ফারুকী, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে কুরআনে বর্ণিত উদ্ভিদ ই,ফা,বা, ২০০৮, পৃঃ ১৩-২০)
>> খেজুর গাছ (আন-নাখিল/আর রাতাব)
খেজুর গাছ থেকে যে খেজুর উৎপন্ন হয় তা অনেক শক্তিশালী খাদ্য। যা মানুষের জন্য অনেক উপকারি। খেজুর বান্দার জন্য মহান আল্লাহ তাআলার এক মহা নেয়ামত।
আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে উল্লেখ করেন, ‘এবং শস্যক্ষেত ও দুর্বল ও ঘন গোছাবিশিষ্ট খেজুর বাগানে।’ (সুরা শুআরা : আয়াত ১৪৮)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তুমি খেজুর গাছের কাণ্ড ধরে নাড়া দাও। তোমার ওপর তা ফেলবে পাকা তাজা খেজুর।’ (সুরা মরিয়াম : আয়াত ২৫)।
>> জলপাই (আজ-জায়তুন)
মহা ঔষুধিগুণে ভরপুর জলপাই। জলপাই অনেক ধরনের হয়ে থাকে। এ থেকে তৈরি হয় অনেক উন্নতমানের তেল। যার কদর রয়েছে বিশ্বব্যাপী। আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে এ জয়তুন তথা জলপাইয়ের শপথ করে বলেছেন, ‘ডুমুর ও জলপাই (বা তার গাছের) এর শপথ।’ (সুরা ত্বীন : আয়াত ১)
আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে বলেন, ‘যিনি তোমাদের জন্য তা (পানি) দিয়ে শস্য, জাইতুন, খেজুরগাছ, আঙুর ও সব ধরনের ফল ফলান। অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’ (সুরা নাহল : আয়াত ১১)
>> আঙুর ফল (আল-ইনাব)
লতাজাতীয় উদ্ভিদ থেকে উৎপন্ন ফল হলো আঙুর। অনেক সুমিষ্ট ও উপকারি ফল এটি। একই থোকায় ৬ থেকে ৩০০টি পর্যন্ত উৎপন্ন হয়। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা এ ফলের কথা তুলে ধরেছেন।
বিজ্ঞানে প্রমাণিত যে, অনেক জটিল ও কঠিন রোগের প্রতিষেধক রয়েছে লতা জাতীয় উদ্ভিদ থেকে উৎপন্ন ফল আঙুরে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং আঙুর ও শাক-সবজি।’ (সুরা আবাসা : আয়াত ২৮)
>> আনার (আর-রুম্মান)
ডালিম নামে পরিচিত ফলই কুরআনের ভাষায় রুম্মান। গুল্ম জাতীয় গাছ থেকে উৎপন্ন হয় এ ফল। এটাকে অনেকে আনার হিসেবেই জানে।
এ ফলটির কথাও কুরআনে এসেছে- ‘সেখানে রয়েছে ফলমূল; খেজুর ও আনার।’ (সুরা আর-রাহমান : আয়াত ৬৮)
>> ডুমুর (আত-ত্বীন)
বিশ্বব্যাপী বহু প্রজাতির ডুমুর রয়েছে। এক ধরনের মিষ্টি জাতীয় পাতলা আবরণযুক্ত নরম ফল ডুমুর। গাছ, লতা, গুল্ম জাতীয় ভিন্ন ভিন্ন গাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের ডুমুর উৎপন্ন হয়। কুরআনুল কারিম এ নামে একটি সুরাও নাজিল হয়েছে।
আর তাহলো সুরা ত্বীন। ত্বীন শব্দের অর্থেই হলো ডুমুর। আল্লাহ বলেন, ‘ডুমুর ও জলপাই (বা তার গাছের) এর শপথ।’ (সুরা ত্বীন : আয়াত ১)
>> শস্য (আজ-জারউ)
নানান ধরনের বীজচারা বা শস্যের কথা কুরআনে তুলে ধরেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘এবং যিনি সৃষ্টি করেছেন খেজুর গাছ ও বিভিন্ন স্বাদের খাদ্যশস্য।’ (সুরা আনআম : আয়াত ১৪১)
>> ঝাউ গাছ (আল-আছলু)
চিরসবুজ নয়নাভিরাম দৃষ্টিনন্দন পাতা বিশিষ্ট উদ্ভিদ ঝাউ গাছ। এর কোনোটি গাছ বিশিষ্টি আবার কোনোটি লতাগুল্ম বিশিষ্ট। এটির কথাও আল্লাহ তাআলা কুরআনে তুলে ধরেছেন-
‘আমি তাদের বাগান দুইটিকে এমন দুই বাগানে পরিবর্তন করলাম, যেখানে রইল কিছু বিস্বাদ ফল, ঝাউ গাছ ও কুল গাছ।’ (সুরা সাবা : আয়াত ১৬)
>> ডালা বিশিষ্ট (মেসওয়াক) গাছ (আস-সাজারু)
মেসওয়াক করার জন্যও আল্লাহ তাআলা গাছ সৃষ্টি করেছেন। এ গাছকে কেউ কেউ জয়তুন গাছ আবার ইংরেজিতে টুথব্রাশ ট্রি বলে থাকে।
ডালবিশিষ্ট এ গাছকে কুরআনের ভাষায় (আস-সাজারু) বলা হয়। আল্লাহ বলেন, ‘লতাপাতা ও বৃক্ষরাজি তাকে সিজদা করে।’ (সুরা আর-রহমান : আয়াত ৬)
>> মেহেদি গাছ
মেসওয়াক করার জন্যও আল্লাহ তাআলা গাছ সৃষ্টি করেছেন। এ গাছকে কেউ কেউ জয়তুন গাছ আবার ইংরেজিতে টুথব্রাশ ট্রি বলে থাকে।
>> আদা (আজ-জানজাবিলু)
এক ধরনের মূল্যবান সুগন্ধি হলো আদা বা আজ-জানজাবিলু। মানুষ এটিকে মসল্লা ও ভেষজ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। পরকালে এ আদা হবে মানুষের শুরা পানের উপকরণ।
আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন, ‘তারা সেখানে এমন শূরা পান করবে, যাতে মেশানো থাকবে ‘জানজাবিল’।’ (সুরা দাহর : আয়াত ১৭)
>> মটর-কলাই বা মসুর (আল-ফুমু)
মসুর, মটরকলাই সম্পর্কে কুরআনুল কারিমের উল্লেখ করা হয়েছে। যা মানুষ খাদ্যশস্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। মানুষের প্রতিদিনের খাবার তালিকায় এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
আল্লাহ তাআরা বলেন, ‘তারা বলল, তুমি তোমার প্রভুর কাছে প্রার্থনা করো। যেন তিনি আমাদের জন্য ভূমিজাত খাদ্যদ্রব্য— তরকারি, শসা, গম, মসুর ও পেঁয়াজ উৎপন্ন করেন।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ৬১)
>> পেঁয়াজ-রসুন (আল-বাসালু)
পেঁয়াজ-রসুন মসল্লা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এতে রয়েছে অনেক উপকারিতা।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা বলল, তুমি তোমার প্রভুর কাছে প্রার্থনা করো। যেন তিনি আমাদের জন্য ভূমিজাত খাদ্যদ্রব্য— তরকারি, শসা, গম, মসুর ও পেঁয়াজ উৎপন্ন করেন।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ৬১)
>> লাউ বা কদু (আল-ইয়াকতিন)
লাউ মানুষের জন্য অনেক উপকারি তরকারি হিসেবে পরিচতি। অনেকে লাউবা কদু তরকারিকে সুন্নাত মনে করে খায়। লাউ বা কদু সম্পর্কে কুরআনে রয়েছে বর্ণনা।
আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘আমি তার ওপর একটি লাউ গাছ উদ্গত করলাম।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ৪৬)
>> শস্যদানা (শরিষা) বা বীজ (আল-হাব্বু)
আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শস্যদানার কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলোর উল্লেখ করে একাধিক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
– ‘নিশ্চয় আল্লাহ বীজ ও আঁটিকে অঙ্কুরিত করেন।’ (সুরা আনআম- আয়াত ৯৫)
– শীষ বা মুকুল (আস-সানাবিলু) ‘যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের দৃষ্টান্ত হলো বীজের মতো, যা থেকে সাতটি শিষ বের হয় এবং প্রত্যেক শিষে থাকে ১০০ বীজ।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৬১)
– উদ্ভিদ (আন-নাবাতু) ‘যেন আমি তা (পানি) দিয়ে উৎপন্ন করি শস্যদানা ও উদ্ভিদ।’ (সুরা নাবা : আয়াত ১৫)
>> পুদিনা সুগন্ধি গুল্ম (আর-রায়হানু)
সুগন্ধ গুল্ম বিশিষ্ট পাতা পুদিনা মানুষের জন্য অনেক উপকারি। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘আরও আছে খোসাবিশিষ্ট শস্য ও সুগন্ধি ফুল।’ (সুরা আর-রহমান : আয়াত ১২)
>> কাঁটাযুক্ত গাছ বা ক্যাকটাস
কাঁটাযুক্ত ‘আল খামতু’ বা ‘আরাক’ নামক বিশেষ লতা গাছ। এ বিষয়ে কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘আমি তাদের বাগান দুইটিকে এমন দুই বাগানে পরিবর্তন করলাম, যেখানে রইল কিছু বিস্বাদ ফল, ঝাউ গাছ ও কুল গাছ।’ (সুরা সাবা : আয়াত ১৬)
>> তেঁতো ও বিস্বাদ খাবার (আজ-জাক্কুম)
তেঁতো ও বিস্বাদ খাবার (আজ-জাক্কুম) ফল। যা জাহান্নামিদের জন্য হবে। এসব ফল হবে তেঁতো, বিস্বাদ ও কাঁটাযুক্ত।
আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘আপ্যায়নের (জাহান্নামিদের) জন্য এটাই না উত্তম কাঁটাযুক্ত গাছ?’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ৬২)
>> ডাল-পাতা বিশিষ্ট গাছ (আন-নাজমু ওয়াশ শাজারু)
এমন গাছ যার রয়েছে বড় ডালা ও ঘণ পাতা। বিশাল বৃক্ষরাজি। এসব ডাল, পাতা ও বিশাল বৃক্ষরাজি মহান আল্লাহকে সিজদা করে।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন- ‘লতাপাতা ও বৃক্ষরাজি তাকে সিজদা করে।’ (সুরা আর-রাহমান : আয়াত ৬)
>> শসা (আল-কিসসাউ)
আল্লাহ বলেন, ‘তারা বলল, তুমি তোমার প্রভুর কাছে প্রার্থনা করো। যেন তিনি আমাদের জন্য ভূমিজাত খাদ্যদ্রব্য তরকারি, শসা, গম, মসুর ও পেঁয়াজ উৎপন্ন করেন।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ৬১)
এছাড়াও কুরআনুল কারিমের ফুল, পাতা, ফল, লতা-গুল্ম, বৃক্ষ, উদ্ভিদ বুঝাতে অনেক শব্দের উল্লেখ রয়েছে। আর তাহলো-
– আল কিনওয়ানু এবং আত-তালউ। উভয় শব্দ দ্বারা খেজুর গাছের শীর্ষ কাঁদি বা শিষ বুঝিয়ে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘এবং খেজুর গাছ, যার শীর্ষদেশ কাঁদির ভারে নুয়ে থাকে।’ (সুরা আনআম : আয়াত ৯৯)
– আস-সিদরু বা কুল বা বরই গাছ। কুরআনে এসেছে, ‘কাঁটাবিহীন বরই গাছ তলায়।’ (সুরা ওয়াকিয়া : আয়াত ২৮)
– আল-আব্বু : গৃহপালিত ও বন্যপশু যে ফল খায়, পশুখাদ্য। আল্লাহ বলেন, ‘তাতে উৎপন্ন করেছি ফলমূল ও ঘাস।’ (সুরা আবাসা : আয়াত ৩১)
– আল-কাদবু (শাকসবজি) ‘আমি তাতে উৎপন্ন করি শস্য, আঙুর, শাকসবজি…।’ (সুরা আবাসা : আয়াত ২৪-৩২)
– আল-কাফুরু (কর্পূর ) ‘নিশ্চয় সৎ মানুষ জান্নাতে এমন পাত্রে পান করবে, যাতে মেশানো থাকবে কর্পূর।’ (সুরা দাহর : আয়াত ৫)
এসবই সৃষ্টিজগতের জন্য মহান প্রভুর একান্ত দান ও মহা অনুগ্রহ। মুমিন বান্দার উচিত আল্লাহ তাআলা কর্তৃক দানকৃত এসব নেয়ামতের জন্য শুকরিয়া আদায় করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তার অগণিত অসংখ্য নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার তাওফিক দান করুন। কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক জীবন যাপন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।