দিল্লি মাইনরিটিজ কমিশন (ডিএমসি) একটি তথ্য-অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে উত্তর-পূর্ব দিল্লীতে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে সঙ্ঘটিত মুসলমানদের হত্যা করার জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দেওয়া এবং এর পরিকল্পনাকারী হিসেবে ভারতের ক্ষমতাসীন উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মাঠ পর্যায়ের রাজনীতিবিদ এবং পুলিশকে দায়ি করা হয়েছে।
বহু প্রত্যক্ষদর্শীর স্বীকারোক্তি, এলাকায় গিয়ে পরিচালিত জরিপ, ক্ষতিগ্রস্ত কলোনি ও মসজিদগুলোতে চালানো তদন্ত ও মিডিয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে তৈরি ১৩৪ পৃষ্ঠার এই রিপোর্টটি বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) প্রকাশ করা হয়েছে।
‘রিপোর্ট অব দ্য ডিএমসি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি অন নর্থ ইস্ট দিল্লি রায়োট অব ফেব্রুয়ারি ২০২০’ – শিরোনামের রিপোর্টটিতে সুনির্দিষ্টভাবে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতা এবং দিল্লি পুলিশকে ওই মুসলিমদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার জন্য দায়ি করা হয়েছে, যে দাঙ্গায় মোদি সরকারের হিসাব অনুযায়ী ৫৫ জন নিহত হয়েছে। রিপোর্টটিতে দাঙ্গা উসকে দেওয়ার জন্য সাবেক এমএলএ এবং বিজেপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা হিন্দু সন্ত্রাসী কপিল মিশ্রকে দায়ি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মৌজপুরে কপিল মিশ্রের বক্তব্য দেওয়ার পরপরই তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতা শুরু হয়। ওই বক্তৃতায় তিনি উত্তর পূর্ব দিল্লির জাফরাবাদ থেকে মুসলিম বিরোধী নাগরিকত্ব আইন সিএএ-র প্রতিবাদকারীদের জোর করে সরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রকাশ্যে ডাক দিয়েছিলেন।
তিনি পরিস্কার বলেছিলেন যে, তিনি এবং তার সমর্থকরা বিষয়টিকে নিজের হাতে তুলে নিবেন, যেখানে আইনবহির্ভূত নজরদারির কৌশলের কথা বলেন তিনি। সেখানে তিনি বলেন: ‘কিন্তু এর পর তিন দিনের মধ্যে রাস্তা পরিস্কার না হলে আমরা পুলিশের কথা শুনবো না…’। পুলিশের কথা না শোনার প্রকাশ্য ঘোষণা এবং আইনবহির্ভূত কৌশলগুলো কর্তৃপক্ষের দেখা উচিত ছিল যেগুলো সহিংসতা উসকে দিতে ভূমিকা রেখেছে।
রিপোর্টে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতার জন্য দিল্লি পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদেরকে দায়ি করা হয়েছে।
ওই রিপোর্টের তথ্যানুযায়ী কপিল মিশ্র যখন বলেছিলেন যে, “এরপর আমরা আর পুলিশের কথা শুনবো না…”, তখন পুলিশের নর্থ ইস্ট ডিসট্রিক্টের ডেপুটি কমিশনার বেদ প্রকাশ সুরিয়া তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। এই পর্যায়ে পুলিশ উগ্র হিন্দুত্ববাদী কপিল মিশ্র এবং উপস্থিত অন্য হিন্দুত্ববাদীদের ধরতে ও গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়েছে, যারা তার কথা শুনতে ও উদযাপন করতে এসেছিল। এতে বোঝা যায় যে, তারা প্রথম এবং তাৎক্ষণিক প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে, সহিংসতা এড়ানো এবং জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য যেটা জরুরি ছিল। রিপোর্টের আলাদা একটি অংশ ‘ফাইন্ডিংস অব দ্য রিপোর্ট’ অংশে এই কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনের শেষের দিকে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আরও বেশি করে সমালোচনা করা হয়েছে।
বিভিন্ন মানুষের বক্তব্যে আরও দেখা গেছে যে, পুলিশ ওই এলাকায় টহল দিচ্ছিল, কিন্তু তাদের কাছে যখন সাহায্যের জন্য বলা হয়, তখন তারা অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে বলেছে যে, পদক্ষেপ নেয়ার আদেশ নেই তাদের উপর। এতে বোঝা যায় যে, সহিংসতা ঠেকানোর ব্যর্থতা কোন বিচ্ছিন্ন বা স্বতন্ত্র ঘটনার কারণে হয়নি, বরং বেশ কিছু দিন ধরে সেখানে ইচ্ছে করে নিস্ক্রিয় অবস্থায় ছিল পুলিশ।
দিল্লি পুলিশ তাদের নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে। দিল্লি পুলিশ অ্যাক্ট ১৯৭৮-এর অধীনে এটা করার তাদের অধিকার রয়েছে যেখানে পুলিশ কমিশনার অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ করতে পারে, এবং ‘জনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রয়োজনে’ জনসমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে।
নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ হয় কার্যকর করা হয়নি, অথবা সেটা শুধু নামেই আছে, যেটার কোন প্রয়োগ নেই। পুলিশ একইসাথে আইনবহির্ভূত সমাবেশ বন্ধ করার জন্যও তাদের ক্ষমতার ব্যবহার করেনি, বা সহিংসতায় উসকানিদাতাদের ধরতে, গ্রেফতার করতে এবং আটকে রাখার মতো কোন পদক্ষেপ নেয়নি, এমনটা উল্লেখ করে রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে, কিছু ঘটনায় বরং পুলিশ সহিংসতাকে আরও ‘উসকে’ দিয়েছে।
কিছু স্বীকারোক্তিতে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি সহিংসতায় অংশ নেয়া, শারীরিক হামলা ও হয়রানি করার সুস্পষ্ট অভিযোগ করা হয়েছে। একটি ঘটনায় ৬-৭ জন পুলিশ কর্মকর্তা পাঁচজন মুসলিম ছেলেকে ঘিরে রাখে, তাদের বর্বরভাবে পেটায় এবং তাদেরকে ‘জন গণ মন’ বলতে বাধ্য করে। এদের একজন কয়েকদিন পরে মারা যায়। এই ঘটনায় দায়ের করা এফআইআরে কোন অভিযুক্তের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
সেই সাথে, সহিংসতার শিকার ব্যক্তিরা জানিয়েছেন যে, এফআইআর তৈরিতে হয় দেরি করা হচ্ছে অথবা এগুলোর ভিত্তিতে কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। বা, কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে হামলার শিকার ব্যক্তিদেরকেই গ্রেফতার করা হয়েছে, বিশেষ করে যেখানে তারা ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে অভিযোগ দায়ের করেছে।
এই প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক আইনের নীতিমালা যেগুলো ‘ইউএন বেসিক প্রিন্সিপলস অন ইউজ অব ফোর্সে’ উল্লেখ রয়েছে এবং যেখানে প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ, নিরস্তকরণ পদক্ষেপ এবং জনতার উত্তেজনার প্রাথমিক পর্যায়েই তাদের পুলিশী বেস্টনিতে আবদ্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে, সেই নীতিগুলো এখানে লঙ্ঘন করা হয়েছে।
ডিএমসি রিপোর্টের ফুটনোটে মিডিয়া প্রতিবেদনের বরাতে আরও যেসব উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে সাবেক বিজেপি এমএলএ জগদিশ প্রধান, বিজেপি কাউন্সিলর কানহাইয়া লাল এবং হিন্দুত্ববাদী নেতা রাগিনি তিওয়ারি, যে বিভিন্ন সময়ে বিজেপি নেতাদের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে।
হিন্দুত্ববাদীদের উস্কানির পর, বিভিন্ন জায়গায় উত্তেজিত হিন্দুত্ববাদীরা দ্রুত স্থানীয় এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। তারা “প্রকাশ্যে পেট্রলের বোতল/বোমা, লোহার রড, গ্যাস সিলিণ্ডার, পাথর ও এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র পর্যন্ত বহন করছিল”। যদিও তাদের অস্ত্র আর অস্ত্রগুলো প্রকাশ্যেই দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু জেলা প্রশাসন বা পুলিশ সেখানে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়নি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
একটা বিশেষ প্যাটার্নে সহিংসতা চালানো হয়েছে।
১০০ থেকে ১০০০ জনের বিভিন্ন হিন্দু সন্ত্রাসী গ্রুপ সবাই একই রকমের স্লোগান দিতে থাকে- ‘জয় শ্রী রাম’, এবং এমনকি ‘হর হর মোদি’, ‘মোদিজি, কাট দো ই মুল্লো কো’, ‘আজ তুমঝে আজাদি দেঙ্গে’। তারা বেছে বেছে মুসলিম ব্যক্তি, বাড়ি, দোকান, যানবাহন, মসজিদ এবং অন্যান্য সম্পদের উপর হামলা করতে থাকে। দাঙ্গাটা কোনভাবেই স্বতস্ফূর্ত বিষয় ছিল না, ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত।
হামলার শিকার ব্যক্তিরা বারবার বলেছে যে, তারা যদিও হামলাকারী কিছু ব্যক্তিকে তাদের আবাসিক এলাকার ব্যক্তি বলে চিনতে পেরেছে, কিন্তু তাদের মধ্যে অনেক বহিরাগতকেও তারা দেখেছে। আবাসিক এলাকায় বিভিন্ন কৌশলগত জায়গায় অবস্থান নিয়েছিল হামলাকারীরা। এখানেই বোঝা যায় দাঙ্গার ক্ষেত্রে যে ‘স্বতস্ফূর্ততার’ বিষয় থাকে, এখানে সেটা ছিল না। মানুষের বক্তব্যে বোঝা গেছে যে, এই সহিংসতা ছিল পরিকল্পিত ও টার্গেট ছিল সুনির্দিষ্ট।
তাছাড়া, নারীদেরকেও হয়রানি করা হয়েছে এবং “তাদের হিজাব ও বোরকা টেনে খুলে ফেলা হয়েছে”। এদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রক্রিয়া বিলম্বিত করা হয়েছে এবং আনুপাতিক হারে সেটা দেয়া হয়নি”।
সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর