পারমাণবিক কর্মসূচি শুধু শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্যই। আর যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণই এ কর্মসূচির লক্ষ্য। এরই পরিপ্রক্ষিতে ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ইরানের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। তার অভিযোগ ছিল, ইরান সন্ত্রাসবাদকে মদদ দিচ্ছে। ব্যাহত করছে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়াকেও। যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত এ শাস্তি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরও কঠোর হয়ে ওঠে। তারা চাইছিল, অর্থনৈতিক অবরোধের ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরার পরিবর্তে এর প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে নিতে। কিন্তু চলতি বছরের শুরুর দিকে ইরানের উদারপন্থি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাকে অনেকেই তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে আবার সম্পর্ক স্থাপন এবং দু'দেশের পারমাণবিক প্রকল্প ঘিরে বিরোধ হ্রাসের সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে। কয়েক মাস গড়াতে না গড়াতে চুক্তিটিও স্বাক্ষরিত হলো। তবে এ চুক্তি আসলেই উভয় দেশের বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট কি-না, তা নিয়ে অনেকের মধ্যে এখনও সংশয় রয়েছে। তবে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন মিত্র দেশগুলো চুক্তির বিষয়ে যে নাখোশ, তা স্পষ্ট।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক :ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকেই প্রধানত ইইউ অনুসরণ করে চলে। যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করেই ইইউ ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল এবং রাষ্ট্রটির সঙ্গে এমনকি যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছিল। চলতি মাসের ১০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে ফ্রান্সও এর আগের পর্যায়ের আলোচনা উপলক্ষে ইরানের বিরুদ্ধে অনেক কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছিল। চলতি মাসেই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া হঁলাদ তিন দিনের সফরকালে ইসরায়েলকে নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি প্রক্রিয়া বন্ধ না করা পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা নমনীয় করার বিরোধিতা করবে ফ্রান্স। ইরানের মূল বাণিজ্যিক সহযোগী ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ২০১২ সালে দেশটির সঙ্গে ১৬.৬ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করেছে ফ্রান্স। ইরান এবং ইইউর এ ঘনিষ্ঠ বন্ধন আর অর্থনৈতিক অবরোধ কিছুটা শিথিল হলে দুটি বিষয় মিলে দেশ দুটির মাঝে বাণিজ্যের পরিমাণ অনেক বাড়ত। তো এ চুক্তি ইরানের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্কও এক ধাপ শক্তিশালী করবে বলেই অনেকের ধারণা।
ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক :ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এ চুক্তিকে একটা 'ঐতিহাসিক ভুল' বলে অভিহত করেছেন। ইসরায়েল শুরু থেকেই এ চুক্তির বিরোধিতা করে আসছে। তারা বলতে চাইছে, চুক্তিটির ফলে এই ইসলামী প্রজাতন্ত্র পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সামর্থ্য অনেকটাই রক্ষা করতে পারবে, অথচ অর্থনৈতিক অবরোধ ঠিকই শিথিল হবে। এমনকি শক্তিশালী সেনা আক্রমণের ইঙ্গিত দিয়ে ইসরায়েল এও বলেছে, তার দেশ একাই ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়া বন্ধ করতে পারে। এ চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ককে যেমন টলায়মান করেছে, তেমনি ইরানে ইসরায়েলের সেনা আক্রমণ চালানোর ক্ষেত্রেও তা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ চুক্তি সম্পর্কে কী ভাবছে ইসরায়েল_ এমন প্রশ্নের জবাবে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাবেদ জারিফ বললেন, 'আমাদের অঞ্চলে তো বটেই, পুরো বিশ্বের ওপরেই ছায়া ফেলেছে এই সংকট। এ সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে চুক্তিটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তাই এ নিয়ে কারও উদ্বেগের যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ দেখি না।' এ চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হবে এমন ভাবনা ইসরায়েলকে আরও বেশি হতাশ করেছে। ইসরায়েল সবসময় বলে আসছে, ইরানকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করা উচিত নয়। ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ওপর এর বাজে প্রভাব ইতিমধেই পড়তে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের শান্তি আলোচনা চালানো ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি গত রোববার অবশ্য বলতে ভোলেননি, ইরানের সঙ্গে চুক্তি হলেও যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ঠিকই বজায় রেখে চলবে।
এ চুক্তির ফলে অনেকেই মনে করেন, ইসরায়েল হয়তো বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে বাধ্য হবে, আরব দেশগুলোর সঙ্গে একটা শান্তিচুক্তিতেও হয়তো আবদ্ধ হবে এবং যেসব দেশের সঙ্গে তার স্বার্থের মিল রয়েছে, তাদের সঙ্গে যোগও দিতে পারে। ইরানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আঞ্চলিক আধিপত্য অর্জনের বিপরীতে ভারসাম্য রক্ষাকারী একটি দেশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন ভূমিকা নিতে পারে ইসরায়েল।
সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক :সিরিয়া চুক্তিটিকে স্বাগত জানিয়েছে এবং একে 'ঐতিহাসিক' বলে অভিহিত করেছে। ইরান ও সিরিয়ার মধ্যে দীর্ঘকাল ধরেই অর্থনৈতিক এবং ভূকৌশলগত সুসম্পর্ক রয়েছে। দশকের পর দশক ধরে সিরিয়ার অবকাঠামো খাতে বিশাল পরিমাণ অর্থও বিনিয়োগ করে রেখেছে ইরান। এ বিনিয়োগের মাঝে ইরানের তেল এ এলাকার বাইরে পাঠাতে পাইপলাইন নির্মাণের বিয়য়টিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকারের সবচেয়ে বড় সমর্থক ইরান সরকার। গৃহযুদ্ধ একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এ যুক্তিতে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করছে খুবই সোচ্চারভাবে। সিরিয়া সরকারের প্রতি ইরানের এই সরব সমর্থন ভালো চোখে দেখেনি লেবাননের কিছু রাজনৈতিক সংগঠন। গৃহযুদ্ধের ফলে সিরিয়ার প্রচুর লোক লেবাননে আশ্রয় নিতে থাকে এবং এর ফলে লেবাননে যেমন সম্প্রদায়গত বিরোধ বাড়তে থাকে, তেমনি দেশটির অবকাঠামোগত অবস্থা খারাপ হতে থাকে। সিরিয়াকে সমর্থন দানের কারণে গত সপ্তাহে বৈরুতে ইরানের দূতাবাসের সামনে আত্মঘাতী বোমা হামলা করা হয়েছে। এ ঘটনায় ইরানের একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকসহ ২৫ জন নিহত হয়েছে। আল কায়দার সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন একটি লেবানি গোষ্ঠী এর দায়ও স্বীকার করেছে। তারা একে আসাদের সমর্থক ইরান ও হিজবুল্লাহ উভয়ের প্রতি 'রক্তপাত আর মৃত্যুর বার্তা' বলে অভিহিত করেছে। এরই মধ্যে হিজবুল্লাহ প্রধান সৈয়দ হাসান নাসরুল্লাহও চলতি মাসের শুরুর দিকে বলেছিলেন, ইরান ও পশ্চিমা বিশ্বের মাঝে এ চুক্তির একমাত্র বিকল্প হচ্ছে আঞ্চলিক যুদ্ধ। তিনি মনে করেন, তার দল এবং তাদের মিত্রপক্ষই দেশে এমন কি পুরো উপসাগরীয় অঞ্চলে এ চুক্তির ফলে আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠবে। তবে এ কথাও মনে রাখা জরুরি, আসাদ সরকার আর হিজবুল্লাহ উভয়েই সৌদি আরব, ইসরায়েলসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতাকে যেমন মেনে নেয় না, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতিরও তারা তীব্র সমালোচনা করে থাকে।
অনেকে মনে করেন, সিরিয়া ও লেবানন শেষ পর্যন্ত তেহরান ও ওয়াশিংটনের উষ্ণ সম্পর্ককে হয়তো সন্দেহের চোখেই দেখবে। আবার অনেকে এও মনে করেন, আসাদ সরকারের প্রতি এ পশ্চিমা শক্তিকে হয়তো আরও নমনীয় করে তুলবে। কারণ ইরান সিরিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধকে মিটিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রপক্ষরা ভাবছে, এ চুক্তি হয়তো ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারে সহায়ক করবে, আসাদ সরকার, হিজবুল্লাহ আর ইরাকের নুর আল-মালিকি সরকার এবং অন্যান্য শিয়া গোষ্ঠীকেই শক্তিশালী করবে। এ চুক্তির ফলে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন মিত্র দেশগুলো তাদের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবনা শুরু করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।